২
এলাকার তরুণ যুবকরা তখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া শুরু করেছে।
আগে থেকেই যাচ্ছিল। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি আসার পর গোপনে গোপনে যাওয়া বেড়ে গেল। আমার বয়সী আমার বন্ধুরাও কেউ কেউ চলে গেল। যারা যায়, তারা কেউ কেউ গোপনে গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করে। দেখা করে বলে, কী রে লাল, যাবি? চল যাইগা।
মার সামনেই কেউ কেউ এরকম কথা বলে। মা তাদেরকে বলেন, তোরা যা বাজান, লাল পরে যাইবো।
কেন যে মা আমাকে এভাবে ফিরিয়ে রাখছিলেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সবাই জানে আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কোনও রকমে তৈরি করা একটা টিনের চালায় মা আর আমি থাকি। ধার উধার করে মা কিছু চাল জোগাড় করেন, কিছু আনাজপাতি ডাল মাছ জোগাড় করেন, ওই খেয়ে কোনও রকমে আমরা বাঁচি। কেরামত আলীর শত্র“তায় এই অবস্থা আমাদের। ভাইকে দিয়ে সে আমাদের বাড়ি লুট করিয়েছে। ওই যে আমার বোনকে পাঁচ নম্বর বউ বানাতে চেয়েছিল। মা রাজি হননি দেখে এইভাবে সে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল।
কেরামতের কথা ভাবলে আমার কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশে জন্মে, বাঙালির ঘরে জন্মে, বাঙালি হয়েও কোনও কোনও মানুষ ছিল পাকিস্তানী মিলিটারির নরপশুগুলোর চেয়েও নিকৃষ্ট।
আমার বুকটা তখন ক্রোধে জ্বলে। আমার ইচ্ছে করে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে ফিরে আসি। পাকিস্তানী মিলিটারিগুলোর সঙ্গে গুলি করে মারি কেরামত আর ফজলের মতো বাংলাভাষায় কথা বলা নিকৃষ্টতম জীবগুলোকে।
মাকে বলি এইসব কথা। মা আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে এসে এইসব অনাচারের প্রতিশোধ নিই।
মা বলেন সেই এক কথা। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
খুশিবুজি তখন কুম্বাইলে, মার সইয়ের বাড়িতে। ছোটবোন মাজেদা ঢাকায় বড়ভাইয়ের কাছে। মেজোভাইয়ের খবর নেই। কোথায় আছে কে জানে! শুনেছি বড়ভাইয়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম রেখেছে মামুন। ভাই ভাবী আর তাদের একমাত্র সন্তান , সঙ্গে আছে মাজেদা, আমার ছোটবুজি। কারও কোনও খবর নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না। শুধু তিনজন মানুষের ব্যাপারে নিশ্চিত। যে হ্যাঁ, এই তিনজন মানুষ আমরা বেঁচে আছি। মা খুশিবুজি আর আমি।
মা আর আমি দুজন অসহায় মানুষ কী যে হতাশা নিয়ে বেঁচে আছি তখন। এই হতাশা সহ্য হয় না। এই হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভোররাতের দিকে একদিন আমি একা একা রওনা দিলাম। মুক্তিযুদ্ধে যাবো। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসবো।
মোস্তফা আর আবুল খায়ের আগেই চলে গিয়েছিল। গিয়ে কী যেন কী কারণে আবার ফিরে এসেছে। ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। শুনেছি ফিরে এসেছে কিন্তু কোথায় আছে জানি না।
আমারও শেষপর্যন্ত যাওয়া হলো না। কাঁচামাটিয়া নদী পার হয়ে আটদশ মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে মনে হয়েছিল, এ আমি কী করছি? আমার অসহায় মাকে আমি কার কাছে ফেলে যাচ্ছি? আমি চলে গেলে মার আর থাকলো কে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে ফজল আলীর বাড়ি থেকে পাওয়া ছয়খানা টিনের নড়বড়ে চালার তলায় কুপি জ্বালিয়ে আমার আশায় বসেছিলেন মা। বসে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ছায়ার মতো নিঃশব্দে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কুপির আলোয় দেখি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মা আমার কোরআন শরীফ পড়ছেন।
আসলে কী ঘটেছিল
এই বাড়ির কাজের লোকটির নাম বারেক।
তিরিশ একত্রিশ বছর বয়স। এখনও বিয়ে করেনি। রোগা পটকা কেংলা ধরনের। চেহারায় মিষ্টতা আছে, চোখ দুটো সুন্দর। এক বালতি পানি এনে দরজার বাইরে একপাশে রাখল সে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। তবু বালতি ভরা টলটলে পরিষ্কার পানিটা দেখতে পেলাম। বারেককে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এভাবে বালতি ভরা পানি রাখলে কেন?
বারেক কী রকম একটু রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। গ্রামের লোক হলেও কথা সে মোটামুটি শুদ্ধভাষায় বলে। শুধু দুয়েকটা শব্দের গণ্ডগোল হয়। বিক্রমপুরের মানুষ বলে এলাকার দুয়েকটা শব্দ শুদ্ধভাষার মধ্যে ঢুকে যায়।
এখনও ঢুকল। ‘এমতেই রাখলাম।’
বুঝলাম, ‘এমতেই’ মানে এমনি। বললাম, এমনি এমনি এক বালতি পানি সারারাত এখানে থাকবে?
বারেক আবারও সেই হাসিটা হাসল। থাকলে অসুবিধা কী? পানি অনেক দরকারি জিনিস। কত সময় কত কাজে লাগতে পারে। এই ধরেন রাত্রে আপনার পাও ধোয়ার দরকার হইল, হাতমুখ ধোয়ার দরকার হইল, তখন কষ্ট কইরা চাপকলের ওইখানে না গিয়া এই বালতির পানি দিয়াই কাজটা আপনে সারলেন।
আমার ওসবের দরকার হবে না। আমার ঘুম খুব গভীর। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে যাই। একঘুমে রাত শেষ করি। সকাল সাতটার আগে ঘুম ভাঙে না।
নতুন জাগায় একটু অসুবিধা হইতে পারে।
কিসের অসুবিধা?
ঘুমের। অনেক মানুষ আছে জায়গা বদল করলে, বিছানা বদল করলে সহজে ঘুমাইতে পারে না। আপনে অনেকদিন পর নানারবাড়িতে বেড়াইতে আসছেন। এখানে ঢাকা শহরের মতন ঘুম আপনের নাও হইতে পারে।
ঘরে ঢুকে পুরনো আমলের পালঙ্কে পা ঝুলিয়ে বসলাম।
আমার নানাবাড়ি গ্রাম এলাকার বিশাল বনেদী এক বাড়ি। বাইরের দিকে একতলা পুরনো একটা দালান। সেটাকে বলে কাছারি ঘর। লোকজন এলে ওই ঘরে বসে। তারপর ভেতরবাড়ি। ভেতরবাড়ির চারদিকে চারটা বড় বড় টিনের ঘর। মাঝখানে মাঠের মতন বিশাল উঠোন। পুনুখালা আর বাড়ির বহুকালের পুরনো ঝি রহিমা যে ঘরটায় থাকে তার পাশেই রান্নাঘর। নানা নানী মারা যাওয়ার আগেই বিধবা হয়েছেন পুনুখালা। তাঁর একটা মাত্র মেয়ে। সেই মেয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সিডনিতে ভাল চাকরি করে। আমার কোনও মামা নেই বলে মা আর পুনুখালা এখন এই বাড়ির মালিক। মা তো ঢাকাতেই থাকেন, পুনুখালা থাকেন এই বাড়িতে। দুচার বছরে এক আধবার মা হয়তো আসেন। মার সঙ্গে আমিও এসেছি কয়েকবার। একা কয়েকদিন পুনুখালার কাছে থাকার জন্য এই প্রথম এলাম। আমার এমবিএ শেষ হয়েছে কদিন আগে। এখন কিছুদিন অলস সময় কাটাবো। তারপর চাকরি বাকরিতে ঢুকবো। মা বললেন, যা তোর খালার কাছ থেকে বেড়িয়ে আয়। চলে এলাম।