তখনই আরেকজন রাইফেলের বাট দিয়ে ধামাধাম কয়েকটা বারি মারলো পিটে। তীব্র যন্ত্রণায় প্রাণ ফাটানো চিৎকার দিচ্ছি আমি।
আমার মা সেই মুহূর্তে কোথায়, পাড়ার লোকজন কে কোথায়, কিছুই আমি জানি না।
মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।
কিন্তু জ্ঞান হারায়নি।
জ্ঞান আমার আছে।
নাকমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। উপুড় হয়ে পড়ার ফলে মুখের কাছটায় রক্তে ভিজে উঠেছে মাটি। সেই অবস্থায় দেখি, বুকের কাছে এস এম জি ধরে মিলিটারিদের একজন এগিয়ে এলো আমার কাছে। চুল ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বসিয়ে ফেলল আমাকে। বইঠ, ছালা ছুয়ার কি আওলাদ।
মাটিতে অসহায় ভঙ্গিতে বসে রক্তমাখা মুখ নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে মিলিটারির দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। আমার তখন একটাই কথা মনে পড়ছে। মৃত্যু আমার আর কতটা দূরে? কখন গুলিটা ওরা করবে? কোন মুহূর্তে এই পৃথিবী ছেড়ে যাবো আমি?
আমার তখন মার কথা মনে পড়ে না, ভাইবোনদের কথা মনে পড়ে না। বন্ধুবান্ধব কিংবা প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে না। দিলুর কথাও মনে পড়ে না। মৃত্যু ভয়ে আল্লাহকে ডাকতেও ভুলে যাই আমি।
ক্যাপ্টেন বা মেজর ধরনের একজন অফিসার এলো এসময়। মুঠি করে ধরলো আমার চুল। টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেল রাচ্চায়। নিয়ে আবার সেই গালাগাল, বইঠ, ছালা ছুয়ার কি আওলাদ।
বসতে গিয়ে দেখি, আমার মতন অনেক মানুষ লাইন ধরে বসে আছে। মিলিটারিরা আরও মানুষ ধরে আনছে। আরও মানুষকে লাইন ধরে বসাচ্ছে। লাইন শুধু লম্বাই হচ্ছে।
নাকমুখের ব্যথা রক্ত এসবের কিছুই আমি আর টের পাচ্ছি না। শুধু টের পাচ্ছি বাঁপায়ের বুড়ো আঙুলটায় কী রকম একটা জ্বলুনি, কী রকম একটা ব্যথা। মুমূর্ষু চোখে তাকিয়েছি। দেখি, বাঁপায়ের বুুড়ো আঙুলের পুরো নখটা ওঠে গেছে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে সেই আঙুল থেকে।
ওদিকে একটার পর একটা সাধারণ মানুষ ধরে আনছিল মিলিটারিরা। বাড়ির ভিতর থেকে, বাড়ির বাইরে থেকে। পুকুরে গোসল করতে নেমেছিল লোক, ভেজা কাপড়ে তাদেরকেও ধরে এনেছে। কেউ কেউ সাবান মেখে গোসল করছিল, গায়ে তখনও রয়ে গেছে সাবানের ফেনা।
কতক্ষণ পর দেখি, আমার মাকেও ধরে এনেছে।
কিন্তু মিলিটারিরা কাউকেই মারছে না, কাউকেই কোনও টর্চার করছে না, কিছু বলছেও না। শুধু পাড়ার আণ্ডাবাচ্চা থেকে শুরু করে সব মানুষ ধরে এনে পুকুরপাড়ে লাইন ধরে বসিয়েছে। লাইন করেছে দুটো। একলাইনে পুরুষ, আরেক লাইনে মহিলা।
আমরা যে পুকুরপাড়ে বসে আছি, তার পাশেই রেললাইন। হঠাৎ রেলগাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া গেল। তাকিয়ে দেখি, স্টেশনের দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটা মালগাড়ি। আমরা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। সবাই বুঝে গেছে, আমাদেরকে এখন এই মালগাড়িতে তোলা হবে। বগি ভরে ভরে নিয়ে যাওয়া হবে ময়মনসিংহের দিকে। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের কাছে নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার লাইন ধরে দাঁড় করাবে। সামনে ব্রক্ষ্মপুত্র নদী, পিছনে পাকিচ্চান আর্মি। ট্যা ট্যা করে গুলি ছুঁড়বে। আর আমরা একেকজন লুটিয়ে পড়বো ব্রক্ষ্মপুত্রের জলে। পরদিন আমাদের লাশ ভাসতে থাকবে নদীর এদিক এদিক। পানি সাঁতরে কুকুররা যাবে না সেই লাশ খেতে। ক্ষুধার্ত কাকগুলো উড়ে উড়ে গিয়ে বসবে আমাদের লাশের ওপর। ঠুকরে ঠুকরে খাবে আমাদের চোখ নাক ঠোঁট।
আমার তখন মার মুখটা দেখতে ইচ্ছা করছে।
কই, কোথায় আমার মা?
ওই তো, ওই যে দূরে বসে আছে।
আমাকে তাকাতে দেখে মাও তাকিয়েছে আমার দিকে। চিৎকার করে বলল, ডরাইস না বাজান। কিছু হইব না। আল্লারে ডাক।
আমার শরীরে তখন কোনও রকমের কোনও অনুভূতি নেই। আল্লাহকে ডাকার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়েছে।
এসময় একজন আর্মি অফিসার এগিয়ে এলো।
ছফুটের মতো লম্বা। টকটকে ফর্সা গায়ের রং। চেহারা খুব সুন্দর। সে এসে ইংরেজিতে বলল, তোমাদের মধ্যে ভালো উর্দু কে জানে?
আমাদের মস্তুর এক বোনজামাই ঢাকায় থাকতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঈশ্বরগঞ্জে চলে এসেছে। সেও বসেছিল আমাদের সঙ্গে লাইন ধরে। অফিসারের কথা শুনে উঠে দাঁড়াল, ম্যায় জানতা হো।
মস্তুর বোনজামাই গোসল করতে নেমেছিল পুকুরে। ওই অবস্থায় তাকে ধরে আনা হয়েছে। লোকটার শরীর মাথা সবই ভিজা।
আর্মি অফিসার তাকে উর্দুতে বলল, তুমি সবাইকে বুঝিয়ে বলো, আমরা তোমাদেরকে ধরেছি একটা বিশেষ কারণে। পাকিস্তান আর্মির একজন বাঙালি কর্নেল, তার নাম কর্নেল তাহের। সে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছে। আমরা শুনেছি এই এলাকায় সে গা ঢাকা দিয়ে আছে। ধারণা ছিল তোমাদের মধ্যেই একজন সেই কর্নেল তাহের। আমরা নানা রকমভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম, তোমাদের মধ্যে কর্নেল তাহের নেই। কিন্তু আমরা এও জানি, এই পাড়াতেই কর্নেল তাহেরের শ্বশুরবাড়ি। তার শ্বশুর খুবই নামকরা ডাক্তার। ঠিক আছে, তোমরা যাও, তোমরা মুক্ত।
কর্নেল তাহেরের শ্বশুর, সেই হৃদয়বান বিশাল মাপের ডাক্তার মানুষটিকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল ডাক্তার সাহেবের আরেক মেয়ে নিলুফারকে।
কর্নেল তাহেরের স্ত্রীর নাম লুৎফা। আমি ডাকতাম লুৎফা আপা।
নিলুফার ছিল আমার বন্ধু।
পুরোনাম নিলুফার ইয়াসমিন। সাবিনা ইয়াসমিনের বড়বোন, খান আতাউর রহমানের স্ত্রী, বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গে আমার বন্ধু এই নিলুফার ইয়াসমিনের বেশ একটা মিল ছিল। আমাদের নিলুফারও গান গাইতো। আমি গান গাই, নিলুফার গান গায়। যখন তখন ওদের বাড়িতে ছুটে যাই আমি। পেয়ারাগাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে পেয়ারা ভাগ করে খাই দুজনে। বাড়ির ছেলের মতোই সবাই আমাকে ভালোবাসে। লুৎফা আপা যখন বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে তখন আমাদের কত আবদার, আপার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে কত যে চকলেট বিস্কুট খেয়েছি! রসোগোল্লা খাওয়ার টাকাও অনেকবার দিয়েছেন লুৎফা আপা।