সেই মেজরের সঙ্গে ভাই এসব জিনিসও পাঠিয়েছে।
চলে যাওয়ার সময় মেজর জিজ্ঞেস করলো, আপনার ছেলে বলেছিল, তার একটা বোনও আছে এই বাড়িতে। অর্থাৎ আপনার মেয়ে, সে কোথায়?
মা বলল, সে আছে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
মেজর বলল, ইচ্ছা করলে সে এই বাড়িতে এসেও থাকতে পারে। আপনাদের কোনও ক্ষতি কেউ করবে না।
মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর মা আবার সেজদায় পড়লো। অনেক কান্নাকাটি করলো আল্লাহর কাছে। শোকর গুজার করলো।
আমার মনে যে তখন কী আনন্দ। যাক আমার ভাইটা বাঁইচা আছে।
পরদিন অল্পকিছু টাকার বাজার করে দিলাম মাকে। সংসারে যা যা লাগে কিনেকেটে দিয়ে নিজে বেরিয়ে গেলাম খবর সংগ্রহের কাজে।
মিলিটারি আর রাজাকাররা তখন নিজেরাই আছে বেশ পেরেশানির মধ্যে। এখন আর মেয়ে টেয়ে ধরে এনে ফুর্তি করার সময় নেই তাদের। তারা পাগলের মতো ঘুরছে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে। মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে দুচারজন সাধারণ মানুষ ধরে নিয়ে আসে, এনে ভয়ানক টর্চার করে। ডাকবাংলোর আঙিনায় একটা জাম্বুরা গাছ ছিল। পা উপরের দিকে, মাথা নিচের দিকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে নিরীহ লোকগুলোকে ঝুলিয়ে রাখতো। লোকগুলোর কী যে চিৎকার, কী যে আর্তনাদ আমার কানে আসতো। ঢুফির বাজারে গিয়ে জব্বারদেরকে এসব জানিয়ে আসতাম।
একদিন একটা বিভৎস্য দৃশ্য চোখে পড়ল।
তার আগের রাতে অনেকদিন পর একটা মেয়ের চিৎকার শুনেছিলাম আর্মি ক্যাম্পে। বাবা গো, বাবা গো, মইরা গেলাম গো। আমারে ছাইড়া দাও, তোমরা আমার বাবা।
পরদিন সকালে স্টেশনের দিকে গেছি, রাচ্চার ধারে দেখি একজন যুবতী মেয়ের লাশ পড়ে আছে। শরীরের এদিক ওদিক রক্তমাখা। মুখটা হা হয়ে আছে। কোনও রকমে একটা কাপড় প্যাঁচিয়ে ঢাকা হয়েছে তার লজ্জাস্থান। পথচারিরা আড়চোখে দেখছে লাশ। কিন্তু মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াচ্ছে না, দ্রুত হেঁটে পেরিয়ে যাচ্ছে জায়গাটা।
সেদিনই ঢুুফির বাজার গিয়ে ঘটনাটা বললাম জব্বারকে।
জব্বার গম্ভীর গলায় বলল, আর মাত্র কয়টা দিন।
কথা বলবার সময়, লক্ষ্য করলাম জব্বারের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে, দাঁত কিড়মিড় করছে। অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে করতে নিজের চুল যেন নিজেই টেনে ছিঁড়ে ফেলছে।
গৌরিপুর রাজবাড়িতেও ক্যাম্প করেছে মুক্তিযোদ্ধারা।
কিন্তু শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের ওখানে ভয়াবহ নরহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তান আর্মি। ট্রেন ভরে, মালগাড়ি ভরে, মানুষ ধরে ধরে আনছে কোন কোন জায়গা থেকে। ব্রিজের কাছে এনে লাইন করে দাঁড় করাচ্ছে। তারপর পাখির মতো গুলি করে মারছে। কিশোরগঞ্জ থেকে, আঠারো বাড়ি থেকে, সোহাগী থেকে মানুষ এনে শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের ওখানে মারছে। মেরে ফেলে দিচ্ছে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীতে। মানুষের পঁচা লাশ খাচ্ছে কাক, কুকুরে।
আমি একদিন আর্মির হাতে ধরা পড়ে গেলাম।
খানিক আগে ঢুফির বাজার থেকে ফিরেছি। সকালবেলা দৌড়ে গেছি জব্বারদেরকে এই এলাকার খবর জানাতে। তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল না। তবু নিয়ম মাফিক যা জানাবার জানিয়ে এলাম। যেমন দৌড়ে দৌড়ে গিয়েছিলাম, তেমন দৌড়ে দৌড়েই ফিরে এসেছি। তারপরও দেখি দুপুর প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এমন খিদা লেগেছে, বাড়ি ঢুকে দেখি মা রান্নাবান্না গোসল সেরে জোহরের নামাজ পড়ার জন্য তৈরি হয়েছে। চালার তলায় মাত্র জায়নামাজ বিছিয়েছে, আমি বললাম, খুব খিদা লাগছে মা, তাড়াতাড়ি ভাত দাও।
মা বলল, নামাজ পড়া শেষ করি, তারপর।
আমার আর খিদা সহ্য হচ্ছিল না। তারপরও মার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। পুকুরে গিয়া একটা ডুব দিয়ে এলাম। গামছায় শরীর মাথা মুছে, লুঙ্গি পরে বাড়ির বাইরের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ওখানটায় একটা বেলগাছ, প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়েছে। কোনও কোনও সময় ওই গাছটায় আমরাও চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তাম। বেলগাছে বড় বড় কাঁটা থাকে। সেইসব কাঁটা থাকে মাথার দিককার সরু সরু ডালপালায়, গোড়ার দিকটায় থাকে না। সুতরাং আরাম করেই শোয়া যেত গাছটার ওপর।
পেটের খিদা চেপে রাখার জন্য বেলগাছটাকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছি আমি। নামাজ শেষ করেই ভাত বাড়বে মা, আমাকে ডাকবে। সেই অপেক্ষায় আছি।
প্রচণ্ড খিদায় একটু কী তন্দ্রামতো আসে মানুষের? নাকি শরীর অবসন্ন হয়ে কোনও একটা ঘোর তৈরি হয়? আমারও বোধহয় তেমন কিছু হয়েছিল। সেই ঘোরের মধ্যে হঠাৎ শুনি আমার খুব কাছে চারদিকেই ছুটোছুটি করছে অনেকগুলো বুটপরা পা। বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়েও যেন এগিয়ে আসছে ওরকম অনেক বুটের শব্দ।
চট করেই গাছ থেকে নেমেছি।
নেমে দেখি, চারদিকেই মিলিটারি। এস এম জি, এল এম জি বুকের কাছে ধরা, কারও হাতে রাইফেল, কারও হাতে স্টেনগান। আমাদের পুরো পাড়া ঘেরাও করে ফেলেছে। খালি গায়ে লুঙ্গিপরা আমি। আমার চুল থাবা দিয়ে ধরলো একজন। ধরে সমানে থাপ্পড়, সমানে লাথি। এমনিতেই ক্ষুধায় কাতর, তার ওপর ওরকম মার! চোখের সামনে হাজার হাজার সর্ষে ফুল দেখছি আমি। আমার মাথা ঘুরছে, আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। সর্ষে ফুলের জায়গায় চোখে নেমে আসছে ঘোরতর অন্ধকার।
আস্তে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছি।
ওই অবস্থায়ও মুহূর্তকালের জন্য আমার মনে হলো, আমি যে মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার, মিলিটারিরা কী সেই কথা জেনে গেছে?
তাহলে তো আমার বাঁচার আর কোনও পথ নেই।
এখনই গুলি করে মারবে আমাকে।