ততোদিনে আমাদের দুজন মানুষের সংসারে আবার লেগেছে অভাব অনটন। মার সইয়ের পাঠানো চাল ডাল আনাজপাতি সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের দিন চলে অতিকষ্টে। চারদিকে তখন ভয়াবহ যুদ্ধের ডামাডোল। পুম্বাইল থেকে যে মাউই মা আবার বস্তা ভরে চাল পাঠাবে, তিন চারজন কামলা মজুর দিয়ে পাঠাবে সংসার চালাবার অন্যান্য দ্রব্য সেসবের কোনও উপায়ই নেই।
আমাদের পুরো পাড়াটাতেই চলছে এই রকম অভাব অনটন।
ভালোর মধ্যে কিছুটা ভালো আছে মোচ্চফারা। আমাদের মস্তু। বাজারে ওদের একটা কাপড়ের দোকান আছে আর একটা মুদি দোকান। কাপড়ের দোকানটা বন্ধ পড়ে আছে, মুদি দোকানটা খুলেছে মস্তুর বাবা। টুকটাক কিছু বিক্রিবাটাও হয়। ওই দিয়ে মস্তুদের সংসার চলে। কিন্তু অন্য প্রত্যেকটা বাড়িতেই অভাব।
ওই সময়কার এক রাতের ঘটনা।
উঠোনে নামাজ পড়ছেন মা। সেজদা দিয়ে পড়ে আছেন। কতক্ষণ সেজদায় থাকবে মা নিজেই তা জানে না। আমি শুয়ে আছি আক্কাসের বাড়ি থেকে আনা সেই ছয়খানা টিনের নড়বড়ে চালার তলায়। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছি। আনমনা চোখে সেজদা দেয়া মাকে দেখছি। মার মাথার কাছে পিটপিট করে জ্বলছে অর্ধেক শেষ হওয়া মোমবাতি।
হঠাৎ কাছে কোথাও শুনি, গটগট করে শব্দ হচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারি না শব্দটা কিসের। পরমুহূর্তে বুঝে যাই মিলিটারিদের বুটের শব্দ।
তার মানে মিলিটারিরা ঢুকেছে আমাদের পাড়ায়?
আমি চিৎকার করে মাকে ডাকলাম, মা তাড়াতাড়ি ওঠো। মিলিটারি আসতাছে।
মার কোনও সাড়া নেই।
আমি দুবার তিনবার ডাকলাম।
মা সেজদা থেকে উঠলোই না।
আমি আর কী করি! অন্ধকারেই দৌড়ে চলে গেলাম বাড়ির পিছন দিকটায়। সেই ট্রেঞ্চে গিয়ে ঢুকলাম।
ভয়ে হাতপা কাঁপছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ওদিকে আর্মি ততোক্ষণে আমাদের উঠানে। উঠানে এসে দেখে সেজদায পড়ে আছে আমার মা। মাথার কাছে জ্বলছে আধপোড়া মোম।
মাকে এই অবস্থায় দেখে মিলিটারিরা একটু থমকালো তারপর চারদিকে টর্চ ফেলে ফেলে দেখতে লাগলো সবকিছু। আমাদের নড়বড়ে চালা, শূন্য আঙিনা, সব দেখে সেজদা দেয়া মাকে টেনে তুলল। আপকা এক বেটা হায়ঃ
শুনে মা মনে করল, আমাকে খুঁজতে আসছে মিলিটারিরা। ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে।
সে হাউমাউ করে কান্না শুরু করল।
ট্রেঞ্চে বসে মায়ের কান্নার শব্দটা আমি শুনতে পেলাম। শুনে আশ্চর্য এক অনুভূতি হলো। আমাকে না পেলে তো আমার মাকেই ওরা গুলি করে মারবে। আমি বেঁচে থাকবো আর আমার মাকে ওরা মেরে ফেলবে?
না না, এটা হওয়া ঠিক হবে না। আমি যাবো, আমিই মিলিটারিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। মারতে হলে আমাকেই মারুক ওরা।
এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে দেখি, আমার হাত পায়ের কাঁপন বন্ধ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর কোত্থেকে এসেছে অদৃশ্য এক সাহস। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে আমি যেন আমি না, আমি যেন আসলে রুনু হয়ে গেছি। আমার সেই বন্ধু রুনু, মা বাবার খোঁজে আর্মি ক্যাম্পে একজনকে জামিনে রেখে পাঁচদিনের জন্য বেরিয়ে এসেছিল। আমরা হাজারবার বলার পরেও নিজের জীবনের কথা সে ভাবেনি। জামিনদারকে বাঁচাতে ফিরে গিয়েছিল সেই আর্মি ক্যাম্পে।
রুনু বাঁচাতে গিয়েছিল জামিনদারকে, নিজের জীবনের বিনিময়ে। আর আমি আমার জীবনের বিনিময়ে নিজের মাকে বাঁচাবো না?
ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ালাম মিলিটারিদের সামনে।
আমাকে দেখে মায়ের কান্না আরও বেড়ে গেল। দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে আমাকে আড়াল করে দাঁড়াল।
একজন অফিসার তীক্ষ্মচোখে আমার দিকে তাকালো। ইয়ে কোন হায়?
মা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওরে মাইরেন না বাবারা, ও আমার ছোটছেলে। আমরা দুজনই আছি। আর কেউ বাঁইচা আছে না মইরা গেছে জানি না।
অফিসার বাংলা উর্দু মিশিয়ে বলল, আপকা কই ডার নেহি হায়। হামলোগ মার নে কে লিয়ে নেহি আয়া।
তারপর পকেট থেকে কিছু টাকা বের করল। আপকা এক বেটা হায়, দাউদ কোম্পানি মেঃ
ঘটনা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। যে অফিসার কথা বলছে সে আসলে একজন মেজর। আজই ঢাকা থেকে ঈশ্বরগঞ্জে এসেছে। ঢাকায় দাউদ কোম্পানির অফিসে বড়ভাইয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। কথায় কথায় সে বড়ভাইকে বলেছিল তাকে যেতে হচ্ছে ঈশ্বরগঞ্জে। শুনে বড়ভাই করেছে কি, সেই মেজরকে কিছু টাকা দিয়েছে, দিয়ে বলেছে, ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্পের খুব কাছে আমাদের বাড়ি। সেই বাড়িতে আমার মা, ছোটভাই আর ছোটবোন আছে। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি তা তারা জানে না। তাদের সংসারেও খুব অভাব। এই টাকাটা তুমি আমার মায়ের হাতে পৌঁছে দিও। রাত দুপুরে মেজর তার বাহিনী নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে সেই টাকা পৌঁছে দিতে।
শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি আর আমার মা। একদিকে ভাই যে ভাবী বাচ্চা আর ছোটবোনকে নিয়ে বেঁচে আছে এটা নিশ্চিত হলাম, অন্যদিকে ভাইয়ের পাঠানো টাকায় দুজন মানুষ বেশ কিছুদিন খেয়ে পরে বাঁচতে পারবো।
মনে আছে, বারোশো টাকা পাঠিয়েছিল ভাই। একাত্তোর সালে বারোশো টাকা মানে বিশাল ব্যাপার। দুজন মানুষের তিন চারমাস চলে যাবে।
মার হাতে টাকাটা দিয়ে মেজর তাকালো তার সঙ্গে আসা মিলিটারিদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চটের বড় একটা ব্যাগ হাতে একজন এগিয়ে এলো। সেই ব্যাগ থেকে একে একে বেরুলো সাদা দুখানা ধুতি, বাঁশপাতার শক্তঠোঙায় সুতলি দিয়ে বাঁধা তিন চারসের চিনি, আর বিশাল বিশাল দুটো লিপটন চায়ের প্যাকেট।