জব্বার বলল, এই রকম মাইনষের লেইগা গুল্লি খরচা করনের কাম নাই। বাইড়াইয়া মার শুয়োরের বাচ্চারে।
অবিশ্বাস্য কাণ্ড!
সেই ছেলে একা পিটিয়ে মারলো বাপকে।
পাশাপাশি দুটো ঘটনা। জামিনদারের জন্য নিজের জীবন দিতে চলে গেল রুনু। আর মুক্তিযোদ্ধা ছেলে পিটিয়ে মারলো স্বাধীনতা বিরোধী বাপকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখন চলে গেছে তুঙ্গে। পাকিস্তান আর্মি গেছে দিশেহারা হয়ে। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাদের। ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্প থেকে একদিন কয়েক গাড়ি ভরে মিলিটারি গেল হালুয়াঘাটে। কোনও রকমে জান বাঁচিয়ে ফিরতে পারলো মাত্র কয়েকজন। বাকিগুলোকে সাবাড় করে দিয়েছে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্পে অদ্ভুত ধরনের একজন পাকিচ্চানী সোলজার ছিল। লোকটার নাম লাল খাঁ। সে কখনও আর্মির পোশাকই পরতো না। সবসময় সাধারণ পোশাক। পাকিস্তানী সিল্কের প্রিন্ট করা লুঙ্গি আর ঢোলাঢালা কামিজ পরতো। পায়ে চপ্পল। এই পোশাকে সে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতো। গরিব মানুষের সঙ্গে গিয়ে তামাক খেতো, বাচ্চা কাচ্চাদের সঙ্গে গিয়ে মাঠে ফুটবল খেলতো।
আমার সঙ্গে কেমন কেমন করে একটু খাতির হলো লাল খাঁর।
একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে এইভাবে ঘুইরা বেড়াও, মুক্তিযোদ্ধারা যদি তোমারে গুলি করে মারে?
লাল খাঁ বলল, আমারে কেউ মারবো না। কারণ আমি কাউরে মারি নাই। বাঙালি জাতি কোনও অন্যায় করে নাই। অন্যায় করতাছি আমরা। নিরীহ মানুষের ওপর আমরা জুলুম চালাইতাছি। এইটা আমাদের অন্যায়।
লাল খাঁ কথা বলতো বাংলা উর্দু মিশিয়ে। উর্দুর সঙ্গে কিছু কিছু বাংলা শব্দ। তার কথাবার্তা আমরা পরিষ্কারই বুঝতাম। কামিজের পকেট থেকে প্রায়ই সে আমাদেরকে চিঠি বের করে দেখাতো। এই যে দেখ, দেশ থেকে চিঠি আসছে। আমার বউ কান্নাকাটি কইরা চিঠি লিখছে। একটা ছোট বাচ্চা আছে আমার। বাচ্চাটার কথা খুব মনে হয়। তারে খুব দেখতে ইচ্ছা করে।
বাচ্চার একটা ছবি থাকতো লাল খাঁর পকেটে। আমাকে একদিন সেই বাচ্চার ছবিও দেখালো। ফুটফুটে সুন্দর এক শিশুমুখ। দেখে আমার মনে হলো পৃথিবীর সব শিশুর মুখ একই রকম পবিত্র। কোনও শিশুর মুখেই কোনও পাপচিহ্ন থাকে না। শত্রুতা মিত্রতার চিহ্ন থাকে না। শত্রুর সন্তানকে দেখেও ইচ্ছা করে তার মুখটা বুকে চেপে ধরি। কপালে চুমু খেয়ে বলি, মানুষ হও।
মানুষের বয়স বাড়ে। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয় তারা। কিন্তু অনেক মানুষই আর মানুষ হয় না। দেখতে মানুষের মতো, আসলে জন্তু। যেমন ছিল একাত্তোরের পাকিস্তানী মিলিটারিরা।
লাল খাঁ ছিল বেলুচিচ্চানের লোক।
বেলুচ রেজিমেন্টকে মিথ্যে বলে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল ইয়াহিয়া সরকার। তাদেরকে বলা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তান দখন করে নিতে চাইছে হিন্দুরা। পাকিচ্চানের অন্যান্য রেজিমেন্টের সঙ্গে তোমরাও যাও পূর্ব পাকিচ্চানে। গিয়ে হিন্দুদেরকে মারো। পূর্ব পাকিচ্চানকে বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করো। দুই পাকিচ্চানই মুসলমানদের দেশ। পূর্ব পাকিচ্চানকে হিন্দুদের হাতে তুলে দিও না, দেশটাকে রক্ষা করো।
একথা জেনে পূর্ব পাকিচ্চানে এসেছিল বেলুচ রেজিমেন্ট। এই রেজিমেন্টের সোলজাররা যখন তেজগাঁ এয়ারপোর্টে এসে নেমেছে, গাড়ি চরে যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে, তখন শোনে চারদিককার মসজিদে মসজিদে আজান হচ্ছে। আজানের শব্দ শুনে তারা চমকে উঠেছে। পরস্পর চাওয়া চাওয়ি করেছে পরস্পরের মুখের দিকে। উচ্চপদস্থরা বলাবলি শুরু করলো, আমাদেরকে যে বলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে কোনও মুসলমান নেই, পূর্ব পাকিচ্চান চলে গেছে হিন্দুদের হাতে, এদেশে তাহলে আজান হচ্ছে কেমন করে? চারদিকে এত আজানের শব্দ!
পরে আস্তে ধীরে খবর নিয়েছে তারা। খবর নিয়ে জেনেছে, ইয়াহিয়া সরকার তাদেরকে মিথ্যে বলে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে অতি সামান্যই হিন্দু। এবং তারা অতিশয় নিরীহ। পূর্ব পাকিচ্চানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সংখ্যা শতকরা আশি ভাগ।
এই তথ্য জানার পর বেলুচ রেজিমেন্টে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। নিরীহ নিরস্ত্র মুসলমানের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করবে না। তারা ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।
কিন্তু চাইলেই তো ফিরে যাওয়া যায় না। আর্মির নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাম্পে যেতে হলো তাদের। কোথাও কোথাও দু চারজন হিন্দু মারলো তারা। কিন্তু বেশির ভাগ বেলুচ সোলজারই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেনি।
এই তথ্য কথাটা সত্য আমি জানি না। লাল খাঁর কথায় আর আচরণে কিছুটা বিশ্বাস করেছিলাম।
লাল খাঁ একদিন আমাকে বলল, সে হালুয়াঘাট যাচ্ছে। মানে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ক্যাপ্টেনের আদেশ অমান্য করার সাধ্য তার নেই। সুতরাং সে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধ করবে না। সে অবশ্যই ফিরে আসবে। যুদ্ধে তার মৃত্যু হবে না, কারণ সে কোনও মানুষ হত্যা করেনি।
যাওয়ার সময় পরিষ্কার তার চোখে পানি দেখলাম আমি।
কিন্তু লাল খাঁ আর ফিরে আসেনি। হালুয়াঘাটের যুদ্ধে লাল খাঁ মারা যায়। একজন সৎ পাকিস্তানী সৈনিকের মৃত্যু আমাকে কিছুটা দুঃখি করেছিল।
মাঝে মাঝে সারারাত আমার মা উঠোনে বসে নামাজ পড়তো।
ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাত হোক কিংবা গভীর অন্ধকার রাত হোক, জায়নামাজের সামনের দিকে একটা মোমবাতি জ্বেলে রাখতো মা আর নামাজ পড়তো। এরকম খোলা জায়গায় বসে আল্লাহকে ডাকার মধ্যে তার এক মানসিক প্রশান্তি কাজ করতো।