ক্যাপ্টেনের পাগলামিতে ডাক্তার সাহেব এবার বিরক্ত হলেন, “ওফ! তোমার হয়েছেটা কী?”
–কিছু না। কিছু হয়নি আমার। ওহহহ! তুমিতো ডাক্তার, না? হ্যাঁ, তুমিই ভালো জানবে। আচ্ছা, বলোত এই ভাতারছাড়া মাগীগুলোর সমস্যাটা কী? তোমার কী মনে হয়, বিয়ে না-করে থাকা কি ভালো কথা? ওদের কি বিয়ে করার ইচ্ছে জাগে না? ওদের কি… লাগে না?
ক্যাপ্টেনের বকবকানি আর দাঁত খিঁচুনি দেখে ডাক্তার সাহেব শেষপর্যন্ত হো হো করে হেসেই দিলেন। তারপর, বক্তৃতা দেয়ার মত করে শুরু করলেন, “দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, জগতে নারী-পুরুষের সংখ্যার অনুপাত সমান নয়। বরং, পুরুষের সংখ্যাই কম। ফলে, সব নারীর পক্ষে বিয়ে করাটা সম্ভব হয় না। তবে প্রকৃতিতে কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রকৃতিতে বেশিরভাগ পুরুষ প্রাণীই বহুগামী, আর এক্ষেত্রে তাদের তেমন কোন বাধাও পেতে হয় না। কারণ সুস্থতা এবং সবলতাই প্রকৃতিতে টিকে থাকার প্রধান হাতিয়ার। এ-কারণে, সঙ্গীহীন নারী পশু প্রকৃতিতে দেখা যায় ্না। কিন্তু সভ্য সমাজে এমনটা দেখা যায়। সভ্য দেশগুলোতে, যেখানে নারী-পুরুষ সমান অধিকার ভোগ করে, সেখানে একজন পুরুষের যথেষ্ট পরিমাণ জীবিকা অর্জন করাটা কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার; কারণ তাদের চেয়ে নারীদের সংখ্যা বেশি। তাই যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও একজন নারীকে যদি সঙ্গীহীন থাকতে হয়, তাহলে মানতেই হবে, তার কপাল খারাপ। এমন নারীদের প্রতি সবার সহানুভূতি দেখানো উচিত।”
–সহানুভূতি! ঠিক আছে, তা না-হয় মানলাম। কিন্তু ওরা নিজেরা কি অন্যের প্রতি সহানুভুতিশীল?”
ক্যাপ্টেন সাহেব এবার ডাক্তারকে সব ঘটনা বললেন। এমনকি, তিনি যে সবেমাত্র এ জাতীয় একটা নাটক পড়েছেন তাও বললেন। সব কথা শুনে ডাক্তার সাহেব মদভর্তি বোতলের ছিপির ওপর হাত রেখে বেশ বিজ্ঞের মত বললেন, “এসব অর্থহীন লেখালেখির কোন শেষ নেই। এগুলোকে এত পাত্তা দেয়ারও কিছু নেই। একমাত্র বিজ্ঞানই পারে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে।”
*** *** ***
ছ’ মাস ফুরিয়ে এলো। ক্যাপ্টেনের বাড়ি ফেরার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। এই পুরোটা সময় জুড়েই স্ত্রীর সঙ্গে তার পত্রালাপ হয়েছে। অবশ্য সেগুলো খুব একটা সুখকর ছিল না (স্ত্রী কঠোর ভাষায় তার সমালোচনার জবাব দিয়েছেন)। যাহোক, অবশেষে একদিন ক্যাপ্টেন সাহেব দালাড়ো বন্দরে নামলেন। তার স্ত্রী, বাচ্চারা, দু’জন কাজের লোক আর ওটিলিয়া আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিল। স্ত্রী এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেও তাকে দেখে খুব একটা আন্তরিক বলে মনে হল না। নিতান্ত অনিচ্ছায় সে স্বামীর চুম্বন পেতে কপাল এগিয়ে দিল। ক্যাপ্টেন সাহেব কিন্তু চোখের কোণা দিয়ে ওটিলিয়াকে দেখছিলেন। হারামজাদী জাহাজের মাস্তুলের মত ঢ্যাং-ঢ্যাংয়ে লম্বা, তার-ওপর আবার ছেলেদের মত ছোট করে চুল কাটিয়েছে। পেছন থেকে দেখতে ঠিক একটা ময়লা ন্যাকড়ার মত লাগছে!
রাতে সেই দালাড়ো হোটেলে এসে উঠল ওরা। ব্যাগবোঁচকা রেখে, হাত-মুখ ধুয়ে, খাবার টেবিলে বসল। কেউই অবশ্য তেমন কিছু খেল না। এটা-ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ; তারপর শুধু চা খেল। অন্য কোন পানীয় ছুঁয়েও দেখল না। সবশেষে শোয়ার আয়োজন হল। সেই বিশাল জাহাজে এবার ছেলেমেয়েরা ঘুমালো, আর ক্যাপ্টেন সাহেব পড়ে রইলেন চিলেকোঠার এককোণায়। উহ! কি বিশাল পরিবর্তন! ক্যাপ্টেন সাহেব হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছেন। না-না, বিবাহিত হয়েও বউ ছাড়া থাকা, এ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
পরদিন সকালে ক্যাপ্টেন সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বেরুতে চাইলেন। ইচ্ছে ছিল স্টীমারে করে বেড়াবেন। কিন্তু বাদ সাধল ওটিলিয়া। তার নাকি স্টীমারভীতি আছে। তাছাড়া আজ রবিবার (আরে! রবিবার তো কী হয়েছে? হারামজাদী তুই তোর রবিবার নিয়েই থাক!)। অগত্যা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হল। স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে বেরুবেন তিনি। অনেক কথা জমা হয়ে আছে, একে-অন্যকে অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু এর মধ্যে যেন কোনভাবেই ওটিলিয়া না থাকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ওটিলিয়াকে এড়ানো গেল–শুধু তারা দুজন বের হলেন। অনেকদিন পর হাত ধরে হাঁটলেন তারা। তবে মুখে খুব বেশি কথা বললেন না। অল্পসল্প যা বললেন তা মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য নয়, বরং গোপন করার জন্য। কলেরায় মৃতদের কবরস্থান পার হয়ে সুইস উপত্যকার পথ ধরলেন দু’জনে। পাইন বনে বাতাস লেগে খসখস আওয়াজ হচ্ছিল, আর বড় বড় শাখা-প্রশাখার ফাঁকে ফাঁকে দূরের নীল সমুদ্রের আলো ঠিকরে বেরুচ্ছিল। স্বামী-স্ত্রী হাঁটতে-হাঁটতে একটা বড় পাথরের কাছে গিয়ে বসলেন। সুযোগ বুঝে ক্যাপ্টেন সাহেব চট করে স্ত্রীর কোলের কাছে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত ঝড়টা শুরু হবে! হলোও তাই, স্ত্রী-ই আগে শুরু করলেন, “আমাদের বিয়ে সম্পর্কে কিছু ভেবেছো?”
–না।
ক্ষণিক নীরবতা। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন সাহেব নীরবতা ভাঙলেন “পুরো ব্যাপারটাকে আগাগোড়া তলিয়ে দেখে আমার মনে হয়েছে, এটা আসলে ভাবার মত কোন বিষয় নয়। ভালোবাসা হৃদয়ানুভূতির ব্যাপার, হৃদয় দিয়েই এটা চালিত হওয়া উচিত। দড়ি-কাছি বেঁধে, কাটা-কম্পাস ম্যাপ দিয়ে হিসেব করে ভালোবাসা পেতে গেলে ব্যর্থতা অনিবার্য।”