৫. নোরা যদি সত্যিই তার স্বামীকে নির্বোধ মনে করে থাকে, তাহলে, তার উচিত ছিল অমন নির্বোধ লোকের কাছে সন্তানদের ছেড়ে না দিয়ে বরং নিজের সেখানে থেকে যাওয়া।
৬. নোরার কূটবুদ্ধি দিয়ে হাসিল করা কাজগুলোকে প্রশংসা করেনি বলে স্বামীকে দোষ দেয়া ঠিক হবে না। কারণ, নাটকের শেষ মুহূর্তের আগে সে জানতই না যে, তার স্ত্রী এমন কূটচাল চালতে পারে। নোরা নিজের আসল চরিত্র সব সময়ই স্বামীর কাছে গোপন করেছে।
৭. পুরো নাটকে নোরা আসলে বোকামিই করেছে। সে নিজেও পরবর্তীতে তা বুঝতে পেরেছে কিন্তু মেনে নিতে পারেনি।
৮. সব দিক পর্যালোচনা করে বলা যায়, ওরা একসঙ্গে থাকলে কিন্তু ভবিষ্যতে বেশ সুখে থাকতো। কারণ, নোরার স্বামী তার ভুল বুঝতে পেরেছিল, নোরা নিজেও বুঝতে পেরেছিল যে তার সব আচরণ ঠিক ছিল না।
যাহোক, নাটক নিয়ে আর না। সবকিছু ভুলে চল আমরা আবার নতুন করে শুরু করি। এই আমি আমার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমাদের তো কিছুই হারায়নি। স্বীকার করে নিচ্ছি, আমরা দুজনেই বোকা। তুমি হচ্ছো ছোট্ট নোরা, যাকে ভালোভাবে আদর-যত্ন করা হয়নি; আর আমি হচ্ছি বুড়ো হাদারাম, যে এতদিন ভালোভাবে জানতই না কীভাবে আদর-যত্ন করতে হয়। আসলে আমরা দুজনেই করুণার পাত্র। কিন্তু কী আর করা যাবে, বল? বড়জোর তাদেরকে মন জুড়িয়ে গালাগাল করা যায় যারা আমাদের এসব শেখায়নি। পুরুষ মানুষ হলেও আদপে আমি কিন্তু তোমার মতই কোমল। হয়ত খানিকটা বেশিও হতে পারি! কারণ, আমি বিয়েই করেছি শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্য, তোমাকে নিয়ে ঘর করবো বলে। অতএব, সবকিছু ভুলে চল আমরা বন্ধু হয়ে যাই, আর জীবনের পাঠশালায় যা কিছু নিজেরা শিখেছি তা আমাদের সন্তানদেরও শেখানোর চেষ্টা করি।
আর শোন, তোমার পাঠানো বইটা আগাগোড়া পড়ে মন্তব্য তো পাঠালাম; কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছ, এর বিষয়বস্তু আমাদের জীবনের সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ কি না? আমরা কি একে-অন্যকে ভালোবাসিনি? একে-অন্যের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করিনি? মনে করে দেখ, শুরুর দিকে অনেক বিষয় নিয়েই আমাদের মনোমালিন্য হত; কিন্তু পরবর্তীতে আমরা কি সেগুলোকে শুধরে নিইনি? এ তোমার কেমন খামখেয়ালী শুরু হল, বলো তো? আমার এসব একদম ভালো লাগছে না। ওই ওটিলিয়া আর ওর ক্যাথলিক কলেজের গুষ্টিসুদ্ধ নরকে যাক। যে বইটা তুমি পাঠিয়েছ সেটা আসলে একটা হতচ্ছাড়া-বাজে বই। এটাকে এমন একটা জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা যায় যার মধ্যে যাত্রীদের বাঁচানোর মত যথেষ্ট সংখ্যক বয়া নেই। ফলে যাত্রীরা ডুবে মরে। আমি তন্নতন্ন করে খুঁজে একটা বয়া পেয়েছি, কিন্তু একবার এটা হারিয়ে ফেললে দ্বিতীয়বার হয়ত আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। তোমার কি মনে হয় না, যে বাদামের খোসা ফাটালে ভেতরে পঁচা বেরুবে সে বাদাম না ফাটানোই ভালো? আমার তো মনে হয়, সে বাদাম শুধু শয়তানের জন্য তুলে রাখা রাখা উচিত। যাহোক, প্রার্থনা করি তুমি সুখে থাকো, শান্তিতে থাকো, তোমার স্বাভাবিক বোধ আবার ফিরে আসুক।
বাচ্চারা কেমন আছে? তুমি কিন্তু ওদের কথা উল্লেখ করতে ভুলেই গেছ। বোধহয় নোরার হতভাগ্য বাচ্চাগুলোকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলে, তাই না? (অবশ্য অমন হতভাগ্য বাচ্চা শুধু অমন হতভাগা নাটকেই দেখা যায়!)। আমার ছোট্ট সোনা ছেলেটা কি কাঁদছে? আমার ফুটফুটে নাইটিংগেল পাখি কি গান গাইছে? আর সর্বোপরি, আমার প্রাণের পুতুল নেচে বেড়াতে ভুলে যায়নি তো? অবশ্য সে যদি চায়, তার জীবনসঙ্গী সুখে থাকুক তাহলে তার ভুলে যাবার কথা নয়। যাহোক, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, যাবতীয় অমঙ্গল থেকে তোমাকে দূরে রাখুন। আমাদের দুজনের মাঝে যেন কোন ভুল বোঝাবুঝি না হয় এমন প্রার্থনাই করি। তোমাকে হয়ত শেষ পর্যন্তও বোঝাতে পারলাম না আমার মন কতটা খারাপ হয়েছে। বসে বসে মনজুড়িয়ে বইটাকে গালিগালাজ করতে পারলে হয়ত খানিকটা শান্তি পেতাম। যাহোক, এখন থাক সেসব কথা, ঈশ্বর আমাদের সন্তানদের মঙ্গল করুন। ওদের ছোট্ট গালে আমার আদর দিও।
ইতি
তোমার বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী
চিঠিটা পোস্ট করার পর ক্যাপ্টেন সাহেব অফিসারদের মেসে গেলেন। সেখানে খানিকটা মদ্যপান করলেন। জাহাজের ডাক্তারও সেসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ক্যাপ্টেন সাহেব ডাক্তারের দিকে ফিরে এলোমেলোভাবে বললেন, “বাতাসে বারুদের গন্ধ পাচ্ছ? আমি কিন্তু পাচ্ছি। এখন আমি টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো, যাতে আমার ওপর দিয়ে উত্তর-পূর্ব-উত্তর দিক থেকে বাতাস বয়ে যায়।”
ডাক্তার সাহেব ক্যাপ্টেনের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না। কথায় মাতলামির স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
–ওহ! ওটিলিয়া! ওটিলিয়া! ওই মাগী চায়টা কী? ও আমার হাতে জব্দ হতে চায়। ডাইনিটাকে লেবারদের মেসে ছেড়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে রাখতে পারলে ভালো হত। আমি জানি, ওর মত বুড়ি-মাগীর জন্য এটাই উপযুক্ত হবে।
এবারে ডাক্তার সাহেব খানিকটা এগিয়ে এলেন। উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে, বন্ধু?”
ক্যাপ্টেন আবার হেড়ে গলায় চিৎকার করলেন–“প্লেটো, এই শালা প্লেটোই যত নষ্টের গোড়া। ছয় মাস সমুদ্রে থাকলে বুঝতো প্রেম কাকে বলে। এই শালা আবার নৈতিকতার কথা বলে! নৈতিকতা,অ্যাঁ? রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে তোর নৈতিকতা বের করে ছাড়বো, শালা! কোথায় ওটিলিয়া? ওই শালী বিয়ে করলে তখন আর মুখে প্লেটোর কথা ফুটতো না।”