নাস্তা শেষে ওরা ঘুরতে বেরুলো। ব্রিজের কাছে নৌকা বাঁধা ছিল। দুজনে হাত ধরাধরি করে উঠল। স্ত্রী বসল নৌকার হালে, স্বামীর হাতে বৈঠা। তবে মন কিন্তু বৈঠায় নেই। বারবার সে শুধু স্ত্রীর দিকেই তাকায়। স্ত্রীর ছোট্ট নরম গাল, মায়াভরা গভীর চোখ, ঝলমলে পোশাক, সবকিছু মিলিয়ে এক দুর্নিবার আকর্ষণে চোখ যে ফেরানোই যায় না। স্ত্রী কিছুক্ষণ
পর বাতাসের দিকে মুখ করে বসল। উত্তঙ্গ বাতাসের ঝাঁপটা এসে বারবার। তার পোশাক এলোমেলো করে দিচ্ছিল। কোনমতে আবার টেনেটুনে সেগুলো ঠিকঠাক করে নিচ্ছিলো। স্বামী চুপচাপ বসে সবকিছু দেখছিল আর মিটমিট করে হাসছিল। ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিলো স্ত্রীর সাথে কথা বলতে। শেষমেষ একটা বুদ্ধি করল–ইচ্ছে করেই আনাড়ির মত নৌকা চালাতে শুরু করলো। নৌকা একবার এদিক যায়, তো পরমুহূর্তে ওদিক যায়। স্ত্রী রাগ। করে বকাঝকা করতে শুরু করল। স্বামী কিন্তু তাতে বেশ মজাই পেল। উৎসাহভরে বকা খেল, আর স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর তার মাথায় এক নতুন দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলা করল–স্ত্রীকে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা। আমাদের বাবুটাকে সঙ্গে নিয়ে এলে না কেন?”
স্ত্রীকে দেখে বোঝা গেল না দুষ্টুমিটা সে বুঝেছে কি না। বেশ সরলভাবে পাল্টা প্রশ্ন করল, “বাবুকে আনলে ঘুমাতে দিতাম কোথায়?”
“কেন? আমাদের বিশাল জাহাজে!” স্বামীর ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি।
স্ত্রী বোধহয় এবারে কিছুটা আঁচ করতে পারলো–কিছু না-বলে হাসতে লাগল। সে হাসি স্বামীর হৃদয়ে প্রশান্তির আলোড়ন তুললো। তার দুষ্টুমি কিন্তু তখনও শেষ হয়নি, প্রসঙ্গ বদলাবার ভান করে জিজ্ঞেস করল,
“হোটেলের মালকিন তো আমাদের পাশের রুমেই থাকেন, না?”
–হুঁ।
–সকালে কিছু বলেছেন?
–কেন? কিছু বলার কথা ছিল?
–না, মানে, গতরাতে তার ঘুম হয়েছে কি না?
–কেন? সকালবেলা উঠেই আমাকে হঠাৎ এ কথা বলবেন কেন?
“তা-তো আমি বলতে পারবো না! হতে পারে ঘরে ইঁদুর ঢুকল, কি জানালায় খসখস শব্দ হল; কিংবা আরও কত ধরনের শব্দেই তো একজন বয়স্ক মহিলার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তাই না?”
“উফ! তুমি যদি এসব বন্ধ না-কর তাহলে কিন্তু এবার ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেব!” রাগের অভিনয় করল স্ত্রী। দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ পর একটা ছোট্ট দ্বীপের কাছে নৌকা ভেড়াল ওরা। খাবারদাবার নামিয়ে লাঞ্চ সেরে নিল। খানিক জিরিয়ে নিয়ে রিভলবার দিয়ে টার্গেট প্র্যাকটিস করল কিছুক্ষণ। আনন্দে বৈচিত্র্য আনতে কিছুক্ষণের জন্য একটা রডকে বল্লমের মত বানিয়ে মাছ শিকার করার চেষ্টা করল। তেমন সুবিধা করতে না পারলেও এটাকে ওদের কাছে বেশ মজার একটা খেলা মনে হল। বেশ কিছুক্ষণ এই খেলা খেলার পর নৌকায় ফিরল। এবার যাত্রা অসীমের দিকে, নির্মল সৌন্দর্যের দিকে যেখানে তুলতুলে রাজহাঁসেরা জলকেলি করে, আর মাছেরা সাঁতার কেটে বেড়ায় পরম আনন্দে। তবে, এই নির্মল সৌন্দর্যের মাঝেও স্বামী কিন্তু স্ত্রীর সৌন্দর্যকে ভুলল না; বারে বারে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে, চুম্বন করে কখনোই যেন সে ক্লান্ত হয় না…
ঠিক এভাবেই ছয়টি গ্রীষ্ম পার হল। প্রতিবারেই ওদের তারুণ্যের উজ্জ্বলতা সমানভাবে প্রকাশ পেত। আগের বারের মতই প্রাণোচ্ছল, আগের বারের মতই পাগল-পাগল ভাব, আর অবশ্যই আগের বারের মতই সুখী। শীতকালটা ওরা স্টকহোমে নিজেদের ছোট্ট বাড়িটায় কাটাত। এ-সময়টা ওদের জন্য বেশ মজার হত। স্বামী বাচ্চাদের জন্য নৌকা বানিয়ে দিত, কখনো চীন কিংবা দক্ষিণের সমুদ্রের দ্বীপগুলোতে তার দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প বলত, আর বাচ্চারা বড়বড় চোখ করে সেসব শুনতো। মাঝে মাঝে স্ত্রীও নানা কাজের ছুতোয় বাচ্চাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করত, মজার কোন গল্প শুনলে হেসে লুটোপুটি খেত। পুরো ঘরজুড়ে কেমন একটা শান্তির আবেশ তৈরি হত। জগতের কোথাও যেন আর এমন দ্বিতীয়টি হয় না। বাচ্চাদের বাবার গল্পে ক্ষণে-ক্ষণে নতুনতর ঘটনার অবতরণা হত। কখনো জাপানের সূর্য, কখনো ভারতের মন্দির, অষ্ট্রেলিয়ার নৌকা-বর্শা আবার কখনোবা নিগ্রোদের উদ্দাম নৃত্য আর শুঁটকি মাছের গল্প হত। দুনিয়ার কোথায় ভালো আখ হয়, কোথাকার আফিম বিশ্বখ্যাত ইত্যাদি হাজারো গল্পের ছড়াছড়িতে বাচ্চারা মুগ্ধ হয়ে থাকত। তারা হয়ত লক্ষ্যই করত না যে, দিন-দিন বাবার মাথার চুল পাতলা হয়ে আসছে। বাবার নিজেরও অবশ্য এ-নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না; কারণ, বাড়ির বাইরে সে খুব একটা যেত না। যদিওবা যেত, সেই পুরোটা সময় বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যেই তার মন পড়ে থাকত–সেখানেই যে তার স্বর্গ লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধব এলে তাদের সঙ্গে তাস খেলত, কদাচিৎ বারে গিয়ে একটু-আধটু মদপান করত। শুরুর দিকে যখন বাড়িতে তাস খেলা হত, তখন স্ত্রীও মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে খেলতে বসে যেত। কিন্তু এখন তার চার-চারটি সন্তান হয়েছে, সাংসারিক ব্যস্ততাও বেড়েছে। ফলে, আগের মত অতটা সময় নিয়ে আর বসা হয় না এখন। তবুও মাঝেমধ্যে একটু আধটু সময় বের করে খেলা দেখতে বসে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কোন না-কোন কাজে উঠে যেতে হয়। আর যখনই স্বামীর চেয়ারের পাশ দিয়ে যায়, স্বামী আস্তে করে কোমর জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “হাতের আসল কাজ আসলে এটাই!”