“ওরা দুজনেই এখন মৃত। মারা যাবার সময় ফ্রিড ছিল প্রাইভেট সেক্রেটারি। খুব উচ্চাভিলাষী ছিল। ফিল ছিল মেডিকেলের ছাত্র। আর হতভাগ্য আমি! স্বপ্ন দেখেছিলাম মন্ত্রী হবার, অথচ এখন রেজিমেন্টের বিচারকগিরি করি। সময় যে কত দ্রুত বয়ে চলে, চোখেই পড়ে না। তবে আমার চোখের নিচের কালি যে আরও গম্ভীর হয়েছে, কানের পাশের চুলে যে পাক ধরেছে, তা কিন্তু বেশ ভালোভাবেই চোখে পড়ে! কবরের দিকে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি কখনো লক্ষই করিনি।”
–হুম! আসলেই তাই। আমরা বুড়িয়ে গেছি। আমাদের সন্তানদের দেখেই সেটা বোঝা যায়। তোমার লক্ষণগুলো যে আমার মধ্যেও দেখা দিয়েছে, তা নিশ্চয় খেয়াল করেছ? তুমি অবশ্য সব সময়ই এসব এড়িয়ে যেতে চাও।
–না-না ওভাবে বলো না।
–“এটাই যে সত্যি, কী করব বলো? আমি খুব ভালোভাবেই জানি, আমার সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে, চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে; খুব শীঘ্রই হয়তো সামনের দাঁতও পড়ে যাবে।” স্ত্রীর এমন বিষণ্ণতার মাঝে স্বামী একটু বাধা দিলেন,
–চিন্তা করে দেখ, সবকিছু কেমন দ্রুত বয়ে যায়। আমার কী মনে হয় জানো? ইদানীং মানুষগুলো খুব দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে, আগে এমনটা হত না। বাবার বাড়িতে দেখেছি, হরহামেশা ‘হেইডেন’ আর ‘মোজার্ট’ বাজানোনা হত, অথচ বাবার জন্মেরও বহু আগে এরা মারা গেছেন। আর এখন দেখ! এই ক’দিনেই গাউন্ড সেকেলে হয়ে গেল! ছেলেবেলার পছন্দগুলোকে পুরনো হয়ে যেতে দেখা যে কত কষ্টের, বলে বোঝানো যাবে না। তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয় যখন মনে হয়, আমি নিজেই পুরনো হয়ে যাচ্ছি।”
কথাগুলো বলে, স্বামী একবার একটু দাঁড়িয়ে আবার পিয়ানোতে বসলেন। স্বরলিপিটা হাতে নিয়ে এমনভাবে পাতা ওল্টাতে থাকলেন যেন টেবিলের ড্রয়ারে সযত্নে রাখা কোন প্রিয় জিনিস, প্রিয়জনের একগোছা চুল, শুকিয়ে যাওয়া ফুল কিংবা সুতোর কাঠিম খুঁজছেন। স্বরলিপির কাগজটার কালো অক্ষরগুলো তাঁর দুচোখ আটকে দিল–ওগুলো যেন অক্ষর নয়, যেন কতগুলো ছোট্ট পাখি দোল খাচ্ছে! কিন্তু বসন্তের গান কেন শোনা যাচ্ছে না? সেই তারুণ্যের উদ্বেলতা, ভালবাসার গোলাপ ফোঁটা গান, কোথায় হারিয়ে গেল?
হঠাৎ করেই অক্ষরগুলো যেন ঝাপসা হয়ে এল–খুব অদ্ভুত, অপরিচিত ঠেকলো ওদের। যেন জীবন-বসন্তের সাজানো বাগান আগাছায় ছেয়ে গেল! হ্যাঁ, তাই-ই হয়েছে–পিয়ানোর গায়ে ধূলো জমেছে, কাঠের বোর্ড শুকিয়ে গেছে, আর স্বামী-স্ত্রীর অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। সমস্ত রুমটায় একটা দীর্ঘশ্বাস প্রতিধ্বনিত হল। শূন্য-হৃদয় নিংড়ানো ভীষণ ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস, একটা ভীষণ নীরবতা আচ্ছন্ন করল রুমটাকে।
-”তবুও সবকিছুই এক! কী অদ্ভুত!” কী মনে করে যেন, স্বামী হঠাৎ করেই কথাগুলো বলে উঠলেন। “আমাদের গানে, আমাদের বাজনায় সেই ‘ভূমিকা’র অংশটুকু করা হয়নি। আমার স্পষ্ট মনে আছ, হার্প আর কোরাসের সাথে চমৎকার একটা ভূমিকা’র অংশও ছিল। সুরটা অনেকটা এরকম…” গুনগুন করে সুর ভাজলেন তিনি। মনে হচ্ছে, যেন কোন সংকীর্ণ উপত্যকা বেয়ে শীর্ণ এক নদীর ধারা নেমে আসছে। নোটের পরে নোট আসছে ঠোঁটের কিনারায়। ধীরে-ধীরে সেই নোট বেয়ে এক চিলতে হাসির রেখাও উঁকি দিয়ে গেল। স্বামীর চেহারার আচ্ছন্নতা উধাও হতে থাকল। পিয়ানোতে হাত লাগলো তাঁর। সেই হাতের ছোঁয়ায়, যত্নে-বেড়ে ওঠা প্রাণবন্ত তারুণ্য যেন সুরের খাঁদ থেকে উঠে এসে পিয়ানোর বুকে ভালোবাসার বান জাগালো। বেশ জোরালো গলায় তিনি বেজ এর অংশটুকু গাইলেন।
স্ত্রীও এবারে কষ্ট-কল্পনার রাজ্য থেকে নেমে এলেন। কান্না-ভেজানো চোখে তন্ময় হয়ে কিছুক্ষণ স্বামীর গান শুনলেন। তারপর, চোখ-ভরা আনন্দাশ্রু নিয়ে ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন–কী গাইছ তুমি?
–কেন ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া’। আমাদের রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া।
স্বামীর ওপর হঠাৎ যেন কিছু একটা ভর করল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্বরলিপিটাকে স্ত্রীর দিকে ঠেলে দিলেন,
–দেখ! এই দেখ, এই রোমিও আমাদের বাবা-দাদার, এই রোমিও আমাদেরও! পড়ে দেখ, এই আমাদের বেলিনি। ওহ, আমরা আসলে অতটা বুড়িয়ে যাইনি!
স্ত্রী তাঁর স্বামীর ঘন-চকচকে চুলের দিকে তাকালেন। দেখলেন স্বামীর জ্বলজ্বলে চোখ আর দৃপ্ত ভুরু। তাঁর মনের কোণে কোথায় যেন একটু হাওয়া লাগলো।
–“তুমি! তোমাকেও এক অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণী মনে হচ্ছে!” স্বামীর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। “বুড়ো বেলিনিকে দেখে আমরা নিজেরাও ধোঁকায় পড়ে গিয়েছিলাম। আসলে কিন্তু আমরা অতটা বুড়ো হইনি। আমার আগেই কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল।”
–“উঁহু! আমি আগে সন্দেহ করেছি” ঠোঁট উল্টে স্ত্রীর প্রতিবাদ।
–হতেই পারে! তোমার বয়স তো আমার চেয়ে কম।
–না-না-না, তুমিই আগে সন্দেহ করেছ….
আর এভাবেই, স্বামী-স্ত্রী একজোড়া নিষ্পাপ শিশুর মত নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করতে লাগলেন–“দুজনের মধ্যে কে বড়?” এই প্রশ্ন নিয়ে। তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই, কীভাবে কিছুক্ষণ আগেও তাঁরা ‘বুড়িয়ে যাওয়া নিয়ে আফসোস করে কাঁচা চুল পাকিয়ে ফেলছিলেন!