স্ট্রিনডবার্গের বক্তব্যে ছিল ক্ষুরধার তীক্ষ্ণতা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু বলাকে কখনোই বরদাস্ত করতে পারতেন না। ফলে, নরওয়ের বিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের বর্ণনাবহুল নাটকগুলোকে ভীষণ অপছন্দ করতেন, সেগুলোর বিষয়বস্তু নিয়েও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এ-নিয়ে দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়েও শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছিল–একে-অন্যকে খোঁচা দিলে বেশকিছু লেখালেখি করেছেন। তবে, স্ট্রিনবার্গের অনুসারীর সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। টেনিস উইলিয়ামস, এডওয়ার্ড অ্যালবি, ম্যাক্সিম গোর্কি, জন অসবর্নসহ অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক নিজেদের লেখালেখিতে স্ট্রিনবার্গের প্রভাব স্বীকার করেছেন। আমেরিকান নাট্যকার ইউজিন ও’নিল ১৯৩৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর স্ট্রিনডবার্গকে নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে স্বীকার করে তাঁকে ‘সবচাইতে প্রতিভাধর আধুনিক নাট্যকার’ (The greatest genius of all modern dramatists) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। যদিও তার বহু আগেই স্টিনডবার্গ চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। ১৯১১-তে নিউমোনিয়ায়। আক্রান্ত হন। সেরে ওঠার আগেই ‘কোলন ক্যান্সার’ ধরা পড়ে। বেশ কয়েক মাস শয্যাশায়ী থেকে ১৯১২ সালের ১৪ মে স্ট্রিনবার্গ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সুইডিশ সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্য আজও তাঁকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া
এক সন্ধ্যায় গানের স্বরলিপি হাতে বাড়ি ফিরে উচ্ছ্বসিত স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বললেন,
–চল আজ রাতের খাবারের পর আমরা গান করি!
–হুম! তা না-হয় হল; কিন্তু তোমার হাতে ওটা কী?
স্বামী গর্বের সাথে ঘোষণা করলেন,
–‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া’র পিয়ানো ভার্সন। চেনো এটা?
–“অবশ্যই! কিন্তু কাউকে কখনো বাজাতে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।”
স্বামী এবারে আরও উচ্ছ্বসিত হলেন–“ওহহহ! তুমি জানো না কী অসাধারণ এটা! এক সময় এটা ছিল আমার স্বপ্নের মত, আমার ঘোরের মত। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো, আমি মাত্র একবারই এটা শুনেছি, তাও প্রায় কুড়ি বছর আগে।
রাতের খাবারের পর বাচ্চাদের ঘুমাতে পাঠানো হল। পুরো বাড়িতে একরকম নিস্তব্ধতা নেমে এল। এর মাঝেই পিয়ানোর ওপর এক চিলতে আলো দেখা গেল। লিথোগ্রাফের কাগজে ছাপানো শিরোনামে চোখ বোলালেন স্বামী,
–‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া! গাউনড এর সেরা সৃষ্টি। এটা গাওয়া আমাদের জন্য খুব মুশকিল হবে বলে মনে হয় না।
স্বামী গলা খাকারি দিলেন, আর স্ত্রী উচ্চগ্রাম থেকে বাজাতে শুরু করলেন। ডি মেজর’ থেকে গাওয়া শুরু হল।
–“ওয়াও! অসাধারণ! তাই না?” স্বামীর চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক।
–“হুম, হবে হয়তো!” স্ত্রীকে খুব একটা উচ্ছ্বসিত মনে হল না।
–এখন কিন্তু যুদ্ধের বাজনা বাজাতে হবে! এই অংশটুকুর কোন তুলনাই হয় না। আমার মনে আছে, রয়েল থিয়েটারে একটা কোরাসে এটা শুনেছিলাম।
পিয়ানোতে এবার যুদ্ধংদেহী আওয়াজ বাজল।
–“বলেছিলাম না! এখানে যুদ্ধের মার্চ বাজবে।” স্বামী এমনভাবে বলছেন যেন ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া তিনি নিজেই লিখেছেন!
–“জানি না!” স্ত্রীর খাপছাড়া উত্তর। “আমার কাছে তো নিছক পিতলের ঝনঝনানি মনে হচ্ছে!”
স্বামী বেচারা এখনো সুরের তালে মগ্ন আছেন। চতুর্থ দৃশ্যে অপেরা অংশটা শুনতে কেমন লাগবে তা-নিয়ে ভাবছেন। দীর্ঘক্ষণ পর অপেরার অংশ পাওয়া গেল।
–এইতো, এইতো এখানে অপেরা বাজবে।
বড় করে দম নিয়ে তিনি অপেরায় গলা মেলালেন। ট্র্যাম, ট্রাম, ট্রা ট্যাম-ট্যা ট্র্যাম, ট্রাম বেজ বাজতে থাকলো।
বাজনা শেষ হবার পর স্ত্রী মন খারাপ করে বললেন, “কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো? আমার কিন্তু এটাকে খুব বিশেষ কিছু মনে হল না।” এইবেলা স্বামী হতাশ হলেন। স্বীকার করতেই হল, বাজনা শুনে তাঁর নিজের কাছেও ফাঁপা কলসির আওয়াজের মত মনে হয়েছে।
–“বাজানোর সময়ই আমি বুঝেছি” স্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তি। “সত্যি বলতে কি, এগুলোকে বেশ পুরনো মনে হল!”
–“ভাবতে অবাক লাগছে, এর মধ্যেই গাউন্ড পুরনো হয়ে গেল!” স্বামীও সহমত পোষণ করলেন। তারপর, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, “তুমি কি আর কিছুক্ষণ বাজাতে পারো?” পরক্ষণেই তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল: “তারচেয়ে বরং চল তিন তালের ‘ক্যাতিনা বাজানো যাক। মনে আছে? উহ! উঁচু স্কেলের অংশটুকু একেবারে যেন স্বর্গীয়!”
কিন্তু এবারে বাজনা শেষ হবার পর স্বামীকে আগের চেয়েও বেশি বিষণ্ণ মনে হল। স্বরলিপিগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলেন তিনি, যেন এভাবে অতীতের দরজাকে বন্ধ করতে চাচ্ছেন। “চল একটু বিয়ার খাওয়া যাক”, বিমর্ষ স্বামীর প্রস্তাব। দুজন দুটো চেয়ার টেনে টেবিলের পাশে বসে বিয়ার খেতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর স্বামী প্রথম মৌনতা ভঙ্গ করলেন।
–“মানতে কষ্ট হচ্ছে, আমরা বুড়ো হয়ে গেছি। এতক্ষণ যেন আমরা ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া’র সঙ্গে পাল্লা দিলাম, কে আগে বুড়িয়ে যেতে পারি! কুড়ি বছর আগে প্রথম শুনেছিলাম। তখন আমি টগবগে যুবক। চারপাশে কত বন্ধুবান্ধব ছিল, কত হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ঠোঁটের ওপর সে-বার প্রথম গোঁফের রেখা দেখা দিল, কলেজের নতুন ক্যাপ মাথায় কী গর্ব হচ্ছিল আমার! মনে হয় যেন, এইতো সেদিন–ফ্রীড, ফিল আর আমি মিলে অপেরায় গেলাম। তার মাত্র কিছুদিন আগে আমরা ‘ফস্ট’ শুনেছিলাম, আর সেবার ‘গাউন্ড’ শুনেতো রীতিমত ভক্ত বনে গেলাম। কিন্তু রোমিও আমাদের সব প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেল। এক বুনো উদ্দামতা যেন গ্রাস করেছিল আমাদের! আর এখন…?” স্বামীর বুক থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।