মাহবুব সিদ্দিকী বয়সে তরুণ, নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন এবং পেশাগত জীবনেও তার ছাপ বজায় রাখতে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পেশাদার অনুবাদক তিনি নন, আমি বলবো এটি একটি শুভবার্তা। কারণ, পেশাদার অনুবাদক মানে এই কাজটির মাধ্যমেই তার জীবিকার সংস্থান হয়। ফলে, যত বেশি সম্ভব অনুবাদ তাকে করতে হয় একটি সীমিত ব্যবধিতে। সেক্ষেত্রে কোয়ালিটি বনাম কোয়ান্টিটি এর চিরন্তন সংঘাতে তাকে মধ্যবর্তী একটি সমঝোতায় আসতে হয়। মাহবুব সিদ্দিকীর সেই বাস্তবতা নেই, তিনি অনুবাদ করেছেন গভীর আন্তরিকতা থেকে। ফলে, যত্ন এবং নিষ্ঠার সমন্বয়ে গুণগত উৎকর্ষের একটি মাত্রায় পৌঁছতে তাঁর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। আমার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর অনুবাদের প্রাথমিক পাণ্ডুলিপিটি পড়বার। পাঠ পরবর্তীতে অনুবাদের কিছু অংশের ব্যাপারে তাঁকে মতামত দিই যেখানে আরেকটু উন্নতির সুযোগ রয়েছে। সেই পরিক্রমায় জানতে পারি, শুধু আমি একা নই, তাঁর পাণ্ডুলিপি পাঠকের তালিকায় ছিলেন আরও বেশ ক’জন সাহিত্যানুরাগী, যাদের প্রত্যেকের মতামতের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল থেকে অনুবাদে প্রয়োজনীয় পরিমার্জনার কাজটি করা হয়েছে। একটি অনুবাদ প্রকল্পে এতজন মানুষের মতামত নিয়ে সেই অনুযায়ী সংশোধনের পদক্ষেপ নেয়া কাজটির প্রতি অনুবাদকের শতভাগ নিবেদনকেই স্বতঃসিদ্ধ করে। তাই, মাহবুব সিদ্দিকী ভবিষ্যতেও অনুবাদের কাজটি অব্যাহত রাখলে আমাদের অনুবাদ-সাহিত্য যে আরও সমৃদ্ধ হবে এ ব্যাপারে নিঃসংশয়েই অভিমত ব্যক্ত করা যায়। প্রতিক্রিয়া একজন শিল্পীর কাজের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি। অনুবাদকও তো একজন শিল্পীই বটে।
যেহেতু এটি তাঁর প্রথম কাজ, পাঠক যদি উৎসাহসূচক মতামত দেন সেটি হয়তো তাঁর অন্তর্নিহিত শিল্পচেতনাকে আরও তেজোদ্দীপ্ত করবে। আমাদের দেশে অভিযোগ করা মানুষের সংখ্যা অগণিত, তুলনায় উৎসাহ দেবার মানুষের সংখ্যা কম। এই সরলীকৃত প্রবণতার বাইরে থেকেই পাঠক তরুণ অনুবাদকের প্রয়াসকে মূল্যায়ন করুক, এটিই প্রত্যাশা। অগাস্ট স্ট্রিনর্গের প্রতি আরও একবার শ্রদ্ধা জানাই, এবং সেই সাথে মাহবুব সিদ্দিকীর জন্যও শুভকামনা রইলো।
ড. কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ইংরেজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কৃতজ্ঞতা
শ্রদ্ধেয় ড.কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় স্যার, যার সুবাদে অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গকে চিনেছি। স্যার না-থাকলে হয়ত স্ট্রিনবার্গ আমার কাছে ‘স্ট্রেঞ্জার থেকে যেত। সেই সঙ্গে, আরও একজন মানুষের নাম না করলেই নয়–শ্রদ্ধেয় শেখ আলাউদ্দিন স্যার। গল্পগুলো ছাপার অক্ষরে পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগে স্যার পড়ে না-দিলে বুঝতেই পারতাম না, ‘আ-কার, ‘এ-কার’, ‘হ্রস্ব ই কার’, ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তি রয়েছে।
ভাইয়া (মাহফুজ সিদ্দিকী) কে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানালে সেটা ন্যাকামো হবে কি না জানি না, ভাইয়া হয়ত পাকামোও বলতে পারে; তবুও, গল্পগুলো পড়ে দিয়ে, দরকার মতো মন্তব্য করে এবং আরও নানাবিধ উপায়ে সহযোগিতা করে এগুলোর কাঠামো দাঁড় করাতে ভাইয়া যে ভূমিকা রেখেছে সেজন্য আমার পক্ষ থেকে যেকোনো রকম অনুভূতি প্রকাশ পেলে দিনশেষে তার নাম কৃতজ্ঞতা-ই হবে।
মাহবুব সিদ্দিকী
ঢাকা
২৩ আগস্ট, ২০১৬
অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ
অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গকে বলা হয় আধুনিক সুইডিশ সাহিত্যের জনক। ১৮৪৯ সালের ২২ জানুয়ারি সুইডেনের স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করা এ মানুষটি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে তিনি নাট্যকার, গল্পকার, চিত্রকর, ঔপন্যাসিক এবং কবি। চার দশকেরও বেশি সময়জুড়ে সুইডিশ সাহিত্যাঙ্গন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আজও তাঁর সৃষ্টিকর্ম তাঁর সময়ের মতই প্রাণবন্ত এবং যুগোপযোগী। দাপিয়ে বেড়ানো’ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই স্ট্রিনডবার্গের সঙ্গে ভীষণভাবে মানানসই। কারণ, প্রচলিত বিশ্বাস আর ধ্যানধারণাকে তিনি অনবরত আঘাত করেছেন তাঁর কলম আর তুলির আঁচড়ে। ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন একগুঁয়েরকম স্বাধীনচেতা। নিজেকে প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচারী ঘোষণা করে তিনি বলতেন–“জীবনের জটিলতার জালে আমরা এত বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়েছি যে, এ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া কখনোই সম্ভব নয়। সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে, সুন্দর করে শুরু করতে হবে।” এ অনুভূতি থেকেই হয়তো জীবনব্যাপী সাহিত্যকর্ম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। গল্প, নাটক আর কবিতার বিষয়বস্তুকে বিভিন্ন সময়ে ভিন্নতর আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। তবে, তিনি সব সময়ই ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’(Natural Law) কথাটায় বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন, আরোপিত কোন মতামত বা বক্তব্য কখনোই মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। একে উল্লেখ করেছেন ‘বৃহত্তর প্রাকৃতিকতাবাদ’ (Greater Naturalism) হিসেবে। নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করতেন, কিন্তু সে সমতার অর্থ এই নয় যে, নারী-পুরুষকে একই কাজ করতে হবে। নারী-পুরুষের মিলন নিয়েও প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর। “দৈহিক মিলন কখনোই ‘কাম-নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়, বরং, মানব মনের সুকুমার প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত।” স্ট্রিনবার্গ আরোপিত নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। ফলে, তথাকথিত নারী আন্দোলন’ বা ‘নারী অধিকার’ শব্দগুলোর প্রতি ভীষণ বিরক্ত ছিলেন। উপরন্তু, এগুলোকে মানবজাতির মধ্যে বিভেদ-সৃষ্টিকারী মতবাদ মনে করতেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে নারী এবং পুরুষ উভয়েরই যথাযোগ্য মর্যাদা পাওয়া উচিত বলে বিশ্বাস করতেন। এ বিশ্বাস থেকেই, ১৮৮৪ সালে সুইডিশ নারীদের ভোটাধিকার আদায়ে তিনি রীতিমত আন্দোলন করেছেন। অনেক সমালোচক স্ট্রিনবার্গকে ‘নারী-বিদ্বেষী’ বলে রায় দিলেও বাস্তবতার নিরিখে একে খারিজ করে দেওয়াই সমীচীন। কারণ, যে সময়ে তিনি নারীদের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্বেষ প্রদর্শন করেছেন সে সময়ে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। অথচ তাঁর বিখ্যাত কাজগুলোর প্রায় সবই ঐ ভারসাম্যহীনতার আগে করা। সর্বোপরি, ‘নিরপেক্ষ অবস্থান বলে কিছু হয় না। লেখকের বক্তব্যকে কালের কষ্টিতে যাচাই করে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের ওপর বর্তায়।