“এক ভাষার সাহিত্যকর্ম অন্য ভাষায় পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা কখনোই সম্ভব নয়” কথাটা হয়ত আংশিক সত্য। পুরো সত্যটা হচ্ছে, সাহিত্যরস আস্বাদনের ক্ষমতা যার রয়েছে তার জন্য ভাষা কোন বাধা নয়। ব্যক্তিগত জীবনে অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ মানুষটা ছিলেন ক্ষ্যাপাটে প্রকৃতির। তাঁর লেখাতেও সে ছাপ বেশ গাঢ়ভাবেই পাওয়া যায়। তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে আমি তাই দেখার চেষ্টা করেছি সেই ক্ষ্যাপাটে মানুষটাকে, বুঝতে চেয়েছি তাঁর বোধকে। গল্পগুলো অনুবাদ করতে গিয়েও এ-স্বাধীনতাটুকু আমি অক্ষুণ্ণ রেখেছি–পাঠকের সামনে স্ট্রিন্ডবার্গকে মূর্তিমান করতে তাঁর গল্পের বক্তব্যকেই অনুবাদ করেছি, লাইনকে করিনি। আশা করি, পাঠক একে সুদৃষ্টিতে দেখবেন। তবুওততা একদিনে ‘মেঘনাদবধ হয় না–গল্পগুলোর অনুবাদে কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়লে নির্দ্বিধায় জানাবেন। পরবর্তী অনুবাদকে আরও সমৃদ্ধ করতে আপনাদের পরামর্শগুলো পথনির্দেশনা হিসেবেই গৃহীত হবে।
মূল বইয়ের সবগুলো গল্পের অনুবাদ এখানে নেই। বাছাইকৃত দশটি গল্প নেয়া হয়েছে। ফলে মূল নামটিও–গেটিং ম্যারেড–এখানে ব্যবহার করা হয়নি। বরং বইয়ের সবচেয়ে আলোচিত–এ ডলস্ হাউস–গল্পটিই বইয়ের শিরোনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পাঠকের গ্রহণ/অগ্রহণই বলে দেবে অবশিষ্ট গল্পগুলোর পরিণতি কী হবে…
মাহবুব সিদ্দিকী
ঢাকা
২২ আগস্ট ২০১৬ ইং
ভূমিকা
অগাস্ট স্ট্রিনবার্গ বাংলাদেশী পাঠক মহলে খুব বেশি পরিচিত না হলেও বিশ্বসাহিত্যে অত্যন্ত সমাদৃত একজন সৃজনশীল মানুষ। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি শাখায় বিচরণ থাকলেও মূলত নাট্যকার হিসেবেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এ বইতে অবশ্য পাঠক তাঁর গল্পকার সত্তার সঙ্গেই পরিচিত হবেন। তবে, আমার কাছে অগাস্ট স্ট্রিনড়বার্গ সবসময়ই একজন প্রতিবাদী মানুষের প্রতিভূ। সে অর্থে আমাদের নজরুলের সঙ্গে তাঁর ভীষণ সাযুজ্য খুঁজে পাই, যিনি সকল প্রতিকূলতার মাঝেও সাম্যের গান গেয়েছেন, বলেছেন–“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” কিন্তু সাম্যের নামে যখন নারী-পুরুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধাচারী দেখিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, দায়িত্ব-কর্তব্য, সমঝোতাকে দাঁড়িপাল্লায় তোলা হতে লাগলো, হেনরিক ইবসেনের তথাকথিত ‘নারীবাদী নাটকগুলোর দোহাই দিয়ে সম্পর্কগুলো সংজ্ঞায়িত হতে লাগলো এককভাবে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে, তখনই অগাস্ট স্ট্রিনবার্গ তাঁর চিরচেনা প্রতিবাদী মূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। পাঠকের সামনে উপস্থাপন করলেন এমন কিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বিষয়কে যেগুলো এড়িয়ে গিয়ে কতিপয় গত্বাঁধা স্থূল-বিষয় নিয়ে সে সময় নারী আন্দোলন দানা বাঁধছিল। স্ট্রিনডবার্গ মনে করতেন, আন্দোলন ব্যাপারটি নিরপেক্ষ; এর শুরুতে ‘নারী বা ‘পুরুষ যেকোন শব্দ জুড়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে সেটিকে একপাক্ষিক করে ফেলা, আর এ ধরনের আন্দোলনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় পোষণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যদিও স্ট্রিনড়বার্গের ব্যক্তিগত জীবন পর্যালোচনায় দেখা যায়, জীবনের এক পর্যায়ে তিনি ভীষণ নারী-বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, সেসময় তিনি পুরোপুরি মানসিক বিকারগ্রস্থ ছিলেন এবং তাঁর গল্পগুলো সে সময়ের অনেক আগে লেখা। যাহোক, আমার মনে হয় বাংলাদেশেও বর্তমানে স্ট্রিনর্গের সময়ের মত একটি একপেশে ধারা চলছে। অনেকটা বোধহয় জোর করেই নারী-পুরুষ সম্পর্কটাকে বারবার আতশি কাঁচের নিচে আনা হচ্ছে এবং পুরুষ কিংবা পুরুষতান্ত্রিক শব্দগুলোকে ঋণাত্বক হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ চেষ্টার চালিকাশক্তি হিসেবে গতানুগতিকভাবেই হেনরিক ইবসেনের নাটকগুলোকে ব্যবহার করা হয়। অথচ ইবসেনের বক্তব্য যে ভিন্ন আঙ্গিক থেকেও উপস্থাপন সম্ভব, কিংবা নাটকগুলোর সূক্ষতর বিশ্লেষণ যে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের বিপক্ষে যেতে পারে এই চিন্তাটি কিন্তু করা হয় না। আমি অবশ্য মনে করি, কোন বিষয়ে নারী বা পুরুষ যে কারো ভুল দেখতে পাওয়া মানেই তার অবস্থান নিচু বা ঋণাত্বক হয়ে যাওয়া নয়। এতে বরং এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা মনুষ্যত্বের সীমার মধ্যেই রয়েছেন, কারণ, “মানুষ মাত্রই ভুল হয়।” কিন্তু এই ভুলগুলোকে যারা খুব বেশি বড় করে তোলেন তারা বুঝতে চান না–বিপরীতপ্রান্তে দাঁড়ানো মানুষটিকে ক্রমাগত অসহনীয় হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা প্রকারান্তরে নিজের অবিবেচকতাকেই প্রকট করে তোলা। তাই, সময় এসেছে ‘জেন্ডার বিষয়টিকে নতুনতর আলোকে চিন্তা করার; এবং তার অংশ হিসেবে স্ট্রিনবার্গ-পাঠ যথেষ্ট ফলদায়ী হবে বলেই আমার ধারনা। সে হিসেবে স্ট্রিনবার্গের গল্প নিয়ে বই প্রকাশ করা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছি।
আমাদের দেশে অনুবাদ-সাহিত্য দীর্ঘদিন ধরেই একটি বিকাশমান মাধ্যম। বলা হয়ে থাকে, মৌলিক লেখার চেয়ে অনুবাদের ক্ষেত্রে মেধা, মনন আর শ্রমের খরচ বেশি হয়। অনুবাদ কেবলমাত্র ভাষান্তর নয়, এর সঙ্গে ভাবেরও প্রয়োজন। এজন্য অনুবাদকের সাহিত্যজ্ঞান প্রখর হওয়া আবশ্যক। অন্যথায়, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় লেখা রূপান্তরিত হবে ঠিকই, কিন্তু লেখার মাঝে প্রাণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠবে। একটি সার্থক অনুবাদ তার শিল্পগুণে হয়ে ওঠে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্ম। তাই স্বপ্রণোদিত হয়ে অনুবাদের দীর্ঘযাত্রার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার অভিলাষে যারা উদ্যোগী হন, তাদের সাধুবাদ জানানো প্রত্যেক সচেতন বইপ্রেমির নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। অনুবাদক শুধু বিদেশী সাহিত্যটিকে নয়, সেদেশের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, ব্যক্তিসম্পর্ক, প্রতিবেশের সাথে নিজ ভাষার পাঠককে পরিচিত করানোর ভূমিকাটিও পালন করেন। সে বিবেচনায় অনুবাদক আদতে একজন ভ্রমণ প্রদর্শক। পাঠকের প্রশান্তিই অনুবাদকের পরিতৃপ্তি।