তার মানেটা দাঁড়ালো এই, সত্যিকার দোষটা আসলে বিয়ের নয়।
মুখবন্ধ
সময়টা নারী অধিকার আন্দোলনের মোটামুটি গোড়ার দিকের। হেনরিক ইবসেনের ‘এ ডলস হাউস’(১৮৭৯) চারদিকে ভীষণ সাড়া ফেলেছে তখন। নারীনেত্রীরা এবং অতি অবশ্যই নারীবাদীরা একে যেন রাতারাতি নিজেদের আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো বানিয়ে ফেললেন। নোরার গৃহত্যাগ যেন গোটা ইউরোপীয়-নারী-সমাজের আদর্শ হয়ে উঠল। সেই সাথে নারী অধিকার আন্দোলনেও যোগ হতে থাকল নতুন নতুন মাত্রা। সমাজ, সংসার, বিয়ে সবকিছুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন তাঁরা; নানা অসংগতি আর জটিলতা খুঁজে বের করতে থাকলেন। কিন্তু এ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের কখন যে তাঁরা ‘এক্সট্রিমিস্ট’ হয়ে উঠলেন, তা নিজেরাও বুঝতে পারলেন না। ফলে, জগৎ সংসারের সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ল পুরুষের ঘাড়ে! আর, নারীর অবস্থান হল যাবতীয় সমালোচনার উর্ধ্বে। ফলে, এ আন্দোলনে বস্তুত নিরপেক্ষতা বলতে কিছু রইল না, এবং স্বাভাবিকভাবেই নারী-পুরুষকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো হল। বাড়তে থাকল বিবাহ-বিচ্ছেদ আর সাংসারিক অশান্তি…
কিন্তু আসলেই কি সব দোষ পুরুষের? কিংবা, সব দোষ নারীর বললেও কি তা যথার্থ হবে? নাকি, দোষ-ত্রুটিগুলো সম্পূর্ণ মানবিক এবং প্রাকৃতিক? এ প্রশ্নগুলোই অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ তুললেন তাঁর ছোটগল্পের মাধ্যমে। ঐ সময় অবশ্য কোন বই আকারে তিনি গল্পগুলো লেখেননি, বরং, প্রতিটি গল্প আলাদাভাবে প্রকাশিত। পরবর্তীতে, ১৮৮৪ সালে এরকম বেশ কতগুলো গল্পকে ‘গেটিং ম্যারেড’ নামে দু’মলাটে আবদ্ধ করা হয়। যে-কারণে কতগুলো গল্পের কাহিনিতে কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। অবশ্য, এর অন্য কারণও ছিল–ঐ সময়ে নারীবাদীরা উঠেপড়ে লেগেছিলেন ‘বিয়ে’ সম্পর্কটাকে ‘মালিক-দাসী’ সম্পর্ক হিসেবে দেখাতে। স্ট্রিনডবার্গের কাছে একে নিতান্ত অমূলক মনে হয়েছে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পরিপূরক; কেউ কারো মালিক বা দাসী নয়, বরং, ক্ষেত্রভেদে একে-অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এ নির্ভরশীলতা মানে অক্ষমতা নয়, ভালোবাসার পূর্ণতা। নারী-পুরুষকে নারীবাদীরা যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়েছেন, স্ট্রিনডবার্গ সেখানে খুঁজে পেয়েছেন সহযোগিতা।
এ ডলস্ হাউস গল্পটি স্ট্রিনবার্গ লিখেছিলেন হেনরিক ইবসেন লিখিত ঐ একই নামের বিখ্যাত নাটকটির প্রতিক্রিয়া হিসেবে। যদিও অতি সাম্প্রতিককালে নাটকটির বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে; প্রশ্ন উঠেছে–ইবসেন নিজে নোরাকে অধিকারবঞ্চিত দেখাতে চেয়েছেন, নাকি নারীবাদীরা নিজেদের মত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নিয়েছেন? (কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের Female Power and Some Ibsen Plays ago দ্রষ্টব্য) কিন্তু ঐ সময়ের প্রচলিত ব্যাখ্যায় (নারীবাদী ব্যাখ্যা) স্ট্রিনবার্গ ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন। সে-কারণেই, ঐ নামের ছোটগল্প লিখে দেখাতে চাইলেন–নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা মানেই নারীদের প্রতি কোন অন্ধ পক্ষপাতিত্বে পৌঁছানো নয়। সংসারে ভুল-ত্রুটি সবারই থাকে, একে যেকোন একপক্ষের বিরুদ্ধে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করাটা আসলে এক ধরনের গোড়ামি।
পরিবর্তনের প্রচেষ্টায়, দেনা-পাওনা, বিবাহিত এবং অবিবাহিত, এবং প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা গল্পগুলোতে স্ট্রিনবার্গ ঐ সময়ের তথাকথিত নারী আন্দোলনকে ব্যাঙ্গ করেছেন। নারীবাদীরা কীভাবে ভীষণ অযৌক্তিক আচরণ করেছেন সেটাই দেখাতে চেয়েছেন। ফলে, এ গল্পগুলোর কাহিনি মোটামুটি একই রকম–প্রতিটি গল্পে তিনি নারীবাদীদের ‘আদর্শ সংসার’ কে প্লট হিসেবে নিয়েছেন; অতঃপর বাস্তবতার আলোকে সে ‘আদর্শ সংসার’ ধারণার ত্রুটিগুলো দেখিয়েছেন।
স্ট্রিনডবার্গের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রচেষ্টা ফুটে ওঠে ক্ষতিপূরণ, বিবাহ অনিবার্য এবং ফিনিক্স গল্পগুলো পড়লে। এ গল্পগুলোতে, তিনি পুরুষের দোষগুলো সামনে এনে নারীর অবস্থানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। সেইসঙ্গে, সামনে এনেছেন এক নির্মম সত্যকে নারী-পুরুষের অবস্থানগত দ্বন্দ্ব যদি থেকেই থাকে, তবে তার দায় এককভাবে নারী বা পুরুষ কারোরই নয়, বরং, চিরায়ত এ অবস্থান তৈরিতে পরিবার এক বিরাট ভূমিকা রাখে, যেখানে নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রকট হয় নারীরই আরেক রূপ (বউ-শাশুড়ি, ননদ-ভাবী ইত্যাদি)। তাই, সত্যিকার পরিবর্তন চাইলে, পরিবর্তনটা আনতে হবে পরিবার সম্পর্কিত সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনায়, শুধুমাত্র পুরুষের দিকে আঙুল তুললে সেটা অন্যায় হবে।
অপ্রাকৃতিক নির্বাচন এবং রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া গল্প দুটোর প্লট সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমটিতে উঠে এসেছে শ্রেণি-বৈষম্য, এবং সেইসাথে আবারও প্রমাণিত হয়েছে, স্ট্রিনডবার্গ সবসময়ই নির্যাতিতের পক্ষে ছিলেন। তাঁর কলম সব সময় ন্যায়ের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। দ্বিতীয় গল্পটি একটি মধুর দাম্পত্য সম্পর্কের গল্প। হয়ত, এটাই স্ট্রিনডবার্গের ‘আদর্শ দাম্পত্য সম্পর্ক, যেখানে ভালোবাসা আছে, আবার ভিন্নমতও আছে; রোমন্থন আছে, খুনসুটিও আছে, এবং দিনশেষে অবশ্যই দুজনের মুখে হাসি আছে।
যাহোক, প্রতিটি গল্পে স্ট্রিনর্গের বিশ্লেষণী ক্ষমতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। গল্পগুলোতে হয়ত কিছু বিষয়ের পুনরাবৃত্তি লক্ষণীয়; কিংবা, কিছু গল্পে হয়ত হেনরিক ইবসেনকে একটু বেশিই খোঁচানো হয়েছে; তবু মানতেই হয়, নারী অধিকারের দোহাই দিয়ে যে ‘এক্সট্রিমিজম’ শুরু হয়েছিল তা থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেয় অগাস্ট স্ট্রিনবার্গের ‘গেটিং ম্যারেড’।