স্বামীর এই অবাধ স্বাধীনতা স্ত্রীর কিন্তু মোটেও পছন্দ হল না। আগে থেকেই সে ছিল স্পষ্টবাদী স্বভাবের, আর এখনতো এমনিতেই গোপন করার কিছু নেই। অতএব, যা কিছু মনে হয় সবকিছু চটপট স্বামীকে বলে বসে। স্বামী কোনরকমে ব্যাপারগুলোকে মোটামুটি ম্যানেজ করে নেয়। ওকালতির পাঁচ ভালোই জানা আছে তার। স্ত্রীর উল্টাপাল্টা কথাবার্তায় বিব্রত না হয়ে, বরং বেশ বুদ্ধিদ্বীপ্ত উত্তর দেয় সে।
একদিন স্ত্রী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “ঘরে বউ রেখে বাইরে-বাইরে ঘোরাটা কি ঠিক?”
“হুম! কিন্তু সে-জন্য তোমরা আমাকে মিস কর বলে তো মনে হয়!” স্বামী কোনমতে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলাল।
–তোমাকে মিস করি কি না? বর যখন ঘর-সংসার দেখাশোনার টাকা মদ খেয়ে ওড়ায়, বউ তখন ঘরে অন্য আরও অনেক জিনিস মিস করে।
–আচ্ছা! তাই নাকি? তবে শোন, প্রথমত, আমি মদ খাই না; মাঝে মাঝে বাইরে থেকে এটা-ওটা কিনে খাই, আর কিঞ্চিৎ কফি পান করি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমি ঘর-সংসার দেখাশুনার টাকা ওড়াইনা; কারণ, সেটা। তোমার কাছেই সযত্নে গচ্ছিত থাকে। পানভোজনের টাকার জন্য আমার। অন্য তহবিল আছে।”
শেষের কথাগুলো স্বামী ঠাট্টাচ্ছলে স্ত্রীর সুর নকল করে বলল।
দুর্ভাগ্যবশত, মেয়েরা কখনোই ঠাট্টা ব্যাপারটা বোঝেনা। ফলে, মজার। ছলে স্বামী যে ফাঁস তৈরি করেছিল, কিছুক্ষণ পর সেটা তার নিজের গলায়ই এসে পড়লো।
–‘পানভোজন!’ তার মানে তুমি স্বীকার করছ, তুমি মাঝে মাঝে মদ খাও?
–মোটেও না। তোমাকে নিয়ে একটু মজা করার জন্য অমন করে বলেছি।
–আমাকে নিয়ে মজা করার জন্য? তার মানে, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে মজা করছ? কই, আগেতো কখনো এমন করতে না!
–আরে বাবা! তুমি নিজেই তো বিয়ে করতে চেয়েছিল; এখন আবার সবকিছু আগের চেয়ে আলাদা করে দেখছ কেন?
–আলাদা করে দেখছি, কারণ আমরা এখন বিবাহিত!
–এটা আংশিক কারণ। পুরো কারণটা হচ্ছে, তোমার মোহ এখন কেটে গেছে।
–আমাদের সেই সময়গুলোকে তোমার কাছে মোহ মনে হচ্ছে?
–শুধু আমার কাছে নয়, তোমার কাছেও; এবং জগতের সবার কাছেই। আসলে আগে-পরে যখনই হোক, এই মোহ একসময় কেটে যাবেই।
–আচ্ছা! তার মানেটা দাঁড়ালো এই যে, যখনই পুরুষের ঘাড়ে দায়িত্ব আসে, তখনই ভালোবাসা তার কাছে মোহ মনে হয়। তাই না?
–হুম! নারীর ঘাড়ে দায়িত্ব এলে তার কাছেও তা-ই মনে হয়।
“মোহ! শুধুই মোহ?” স্ত্রী বিড়বিড় করে বলতে লাগল।
এবারে স্বামী ঝটকা মেরে বলল, “তবে তার মানে এই নয় যে, দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকা যাবে না।”
“অর্থাৎ, বিয়ের প্রয়োজন নেই। তাই বলতে চাইছ তো?” স্ত্রী বেশ রেগে গেল ।
“ঠিক তাই। আমি তোমাকে ঠিক এই কথাটাই সব সময় বোঝাতে চেয়েছি।” স্বামীর স্পষ্ট জবাব ।
“কিন্তু তুমি নিজে কি চাওনি আমাদের বিয়ে হোক?” স্ত্রীকে আবেগী দেখালো ।
–চেয়েছি। তার একমাত্র কারণ, তিন-তিনটা বছর ধরে তুমি এ-নিয়ে আমার মাথা নষ্ট করে ছেড়েছ।
–কিন্তু এটাতো সত্য, তুমি চেয়েছিলে আমরা বিয়ে করি।
–কারণ, তুমি চেয়েছিলে; আর, শেষ পর্যন্ত সেটা পেয়েছ সে-জন্য তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
–তুমি তোমার সন্তানদের মাকে ফেলে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াও, এই জন্য আমাকে কৃতজ্ঞ থাকতে বলছ?
–মোটেই না; বরং, তোমাকে বিয়ে করেছি এই জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে বলছি।
–তুমি কি সত্যিই মনে কর, আমার সে জন্য কৃতজ্ঞ থাকা উচিত?
–হ্যাঁ, মানুষ নিজের পথ খুঁজে পেলে যেভাবে কৃতজ্ঞ থাকে, তোমারও। সেভাবে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
“বেশ! তাহলে তুমিও শুনে রাখ, আমাদের এই বিয়ে কোন বিয়েই নয়। এ-বিয়েতে কোন সুখ নেই। তোমার পরিবার আমাকে স্বীকার করে না।” স্ত্রী রাগে ফেটে পড়ল।
–এর মধ্যে আবার আমার পরিবার এল কেথেকে? আমিতো কখনো তোমার পরিবার নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
–মাথা ঘামাওনি, কারণ, তোমার মনে হয়েছে আমার পরিবার নিয়ে কখনো কোন চিন্তা-ভাবনা না করলেও চলবে।
–আচ্ছা! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন, আমার পরিবার নিয়ে সবসময় তোমার ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা ছিল! এমনকি তারা যদি মুচি চামারও হত, তবুও তাদের নিয়ে তুমি সুখে থাকতে!
–এমনভাবে কথা বলছ যেন মুচি-চামাররা মানুষ না। অন্যদের মত ওদের বাঁচার অধিকার নেই?
–অবশ্যই আছে। তবে আমার মনে হয় না, মুচিদের প্রতি দরদ দেখিয়ে, তুমি ওদের সাথে গিয়ে থাকতে রাজি হতে…
কথা কাটাকাটির এই পর্যায়ে স্ত্রী চিৎকার করে উঠল–“ঠিক আছে! সব ঠিক আছে! তুমি তোমার মত থাক, আমি আমার মত থাকবো।”
আসলে কিন্তু সব ঠিক ছিল না। আসলে, আর কখনোই সব ঠিক হয়নি।
*** *** ***
আচ্ছা, এই সমস্ত সমস্যার মূল কারণ কি তবে বিয়ে? নাকি অন্য কিছু?
লুইসা শেষ পর্যন্ত স্বীকার না করে পারেনি, তাদের আগের সময়টাই ভালো ছিল। সে সময় তারা সুখী ছিল।
স্বামীরও মাঝে মাঝে মনে হয়, তাদের সম্পর্কের বৈধতা দেয়ায়, অর্থাৎ, বিয়ে করার কারণেই অশান্তিটা হয়েছে। কারণ, সে যত বিবাহিত দম্পতি দেখেছে, তাদের সবাই-ই অসুখী। তবে, সবচেয়ে কষ্টকর বিষয়টি সে বুঝতে পারল যখন সেই পুরনো বন্ধু আর সোফির ব্যাপারে জানলো। বিয়ের পর প্রায়ই সে স্ত্রীকে না-জানিয়ে ওদের বাড়িতে যেত। তেমনি একদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারল, ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। “অথচ ওরা কখনো বিয়েই করেনি!”