স্বামী(!) একদিন এক আনন্দের সংবাদ নিয়ে এল রাস্তায় বড় বোনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দেখা গেল, বোন তাদের সব খোঁজ-খবরই জানে। ছোট্ট ভাতিজাটাকে দেখার জন্য সে ভীষণ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কথা দিয়েছে, খুব শীঘ্রই একদিন তাদের বাসায় আসবে। খবরটা শুনে লুইসা বেশ অবাক হলেও তৎক্ষণাৎ ঘরদোর পরিষ্কার করতে লেগে গেল। এ উপলক্ষে একটা নতুন ড্রেসেরও বায়না ধরল।
পুরো সপ্তাহ জুড়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলল। পদাগুলো। লণ্ডিতে পাঠানো হল, চুলা-দরজার হাতল সব ঘষে-মেজে ঝকঝকে করা হল। আসবাবপত্রের ওপরও একপ্রস্থ নতুন রঙ চড়ল। বোন এসে দেখুক, তার ভাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-মার্জিত রুচির একজনের সাথেই থাকে!
অবশেষে সেই দিনটা এল। বেলা ১১টায় বোনের আসার কথা। তার আগেই কফি বানিয়ে রাখলো লুইসা। যথাসময়ে বোনের আগমন ঘটল। থমথমে ভাবলেশশূন্য মুখে সে লুইসার সাথে হাত মেলালো। এরপর ঘরের আসবাবপত্রগুলো বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কিন্তু কিছু খেতে রাজি হল না। এ-ঘর ও-ঘরে উঁকি দিল; কিন্তু ভাইয়ের বউয়ের(!) দিকে আর ফিরেও তাকালো না। তবে বাচ্চাটা নিয়ে সে বেশ আগ্রহ দেখালো। ওকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করল। তারপর, যেভাবে এসেছিল সেভাবেই আবার গটগট করে চলে গেল। পুরো সময়টা জুড়ে লুইসাও কিন্তু বোনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। তার কোট, জামা-কাপড়-গহনার দাম কী রকম হতে পারে ইত্যাদি সব হিসাব করা হয়ে গেছে। সেই সাথে, চুল কাটার একটা নতুন ধরনও শিখেছে। পরবর্তীতে ওভাবে চুল কাটানো যেতে পারে! যা-হোক, বোনের কাছ থেকে খুব আন্তরিক ব্যবহার সে নিজেও আশা করেনি; প্রথমবারের মত যে এসেছে সেটাই যথেষ্ট। অতএব, লুইসাকে সর্বোপরি খুশিই মনে হল। প্রচার করে বেড়ালো, স্বামীর(!) বোন তাদের সংসার দেখতে এসেছিল।
*** *** ***
দিন দিন ওদের ছেলেটা বড় হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে, লুইসা আবার গর্ভবতী হল। এবার ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হল। তার পর থেকে, লুইসা আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে গেল। বাচ্চাদের ভবিষ্যত নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তা হয়। বাচ্চাদের বাবাকে প্রতিদিন বোঝানোর চেষ্টা করে তাদের বৈধ বিয়ে না-হলে বাচ্চাদের ভবিষ্যত কখনোই সুরক্ষিত হবে না। ওদিকে, ব্যারিস্টারের বোনও ইঙ্গিত দিয়েছিল, তাদের একসঙ্গে থাকাকে যদি তারা বিয়ের মাধ্যমে বৈধতা দেয়, তবে পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের একটা সমূহ সম্ভাবনা আছে।
সবদিক বিবেচনা করে, এবং লুইসার দুই বছরের ক্রমাগত চেষ্টার ফলে, অবশেষে তার প্রেমিক বিয়ে করতে রাজী হল। সন্তানদের মঙ্গলের স্বার্থে ওই যুক্তিহীন মন্ত্রগুলোর মাধ্যমে পড়ানো বিয়ে সে মেনে নেবে।
কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যা–“বিয়েটা হবে কোথায়?”
লুইসা চার্চের জন্য জোরাজুরি করল। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? চার্চে বিয়ে হলে তো সোফিকে নিমন্ত্রণ করা যাবে না। ওকে তো নিশ্চয়ই চার্চে ঢোকার অনুমতি দেবে না। “ইস! সোফির মত একটা মেয়ে!” কিন্তু লুইসা এতে দমল না। সে বরং বলল, “সন্তানের মঙ্গলের জন্য বাবা-মাকে ব্যক্তিগত অনেককিছুই ত্যাগ করতে হয়।” অতএব, শেষ পর্যন্ত তারই জয় হল।
বিবাহ সম্পন্ন হল! কিন্তু ব্যারিস্টারের বাবা-মার থেকে কোন নিমন্ত্রণ এলো না। এলো সোফির কাছ থেকে একটা চিঠি। এমন একটা কাজ করার জন্য, বিশেষত, তাকে নূন্যতম কিছু না-জানিয়ে করার জন্য সে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। লুইসাদের সঙ্গে সে আর কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না জানিয়ে দিয়েছে।
লুইসা অবশ্য এতে খুব একটা দুঃখিত হল বলে মনে হল না। সে এখন একজন বিবাহিতা নারী’, এটাই সবচেয়ে বড় কথা! কিন্তু কেন জানি নিজেকে তার আগের চেয়ে অনেক বেশি একাকী মনে হয়। অবশ্য, এক ধরনের স্বস্তিও আছে–তাদের সম্পর্কটা এখন বৈধ।
আর, এই স্বস্তিবোধ থেকেই সে সবরকম স্বাধীনতা ভোগ করতে শুরু করল। সেই-সব স্বাধীনতা, যেগুলোকে বিবাহিত মানুষ নিজেদের অধিকার বলে মনে করে। এক সময় যেগুলোকে সে স্বেচ্ছায়প্রাপ্ত উপহার বলে ভাবত, এখন সেগুলোকে নিজের প্রাপ্য বলে মনে করতে শুরু করল। প্রথমেই সে নিজেকে ‘সন্তানের মা পরিচয়ের আড়ালে ঢেকে ফেলল। আর, এখান থেকেই যেন তার নবযাত্রা সূচিত হল।
ওদিকে, স্বামী বেচারার মাথায় কিছুতেই ঢুকল না, ‘সন্তানের মা এই পরিচয়ের বিশেষ কী মাহাত্ম আছে! তাছাড়া, তার সন্তানেরা তো আর দশটা স্বাভাবিক সন্তানের মতই। তারা এমনকিছু নয় যে, তাদের মা হওয়াটা বিরাট গর্বের কোন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে! পুরো ব্যাপারটা স্বামীর কাছে একটা ধাঁধার মত হয়ে রইল। তবে, তার নিজের স্বভাবেরও খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে আজকাল। মনে কিছুটা খচখচানি থাকা সত্ত্বেও, সে আগের মত আবার বাইরের জগতের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হতে শুরু করেছে। অবশ্য, এর পেছনে যুক্তিও আছে–“সন্তানদের তো তখন একজন বৈধ মা রয়েছে। সুতরাং, বাইরের জগতের যে ব্যস্ততাগুলো সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, সেগুলো আবার শুরু করতে বাধা-তো নেই। মাঝে এগুলো ভুলে যাওয়ার কারণ ছিল প্রথমত, সন্তান হবার আগে সে প্রেমের মায়ায় বিভোর থাকত; দ্বিতীয়ত, সন্তান হবার পর প্রেমিকা আর সন্তানদের রেখে কোথাও যাওয়ার ব্যাপারটাকে সে রীতিমত ঘৃণা করত। এখন যেহেতু সব অনিশ্চয়তা কেটে গেছে, এখন বাইরে যাওয়াই যায়।