লাঞ্চের বিরতির সময় এক সহকর্মী এসে পাশে বসল। বেশ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, “ক্রিসমাসে বাড়ি যাচ্ছ নাকি?”
প্রশ্ন শুনে তরুণ ব্যারিষ্টার দপ করে জ্বলে উঠল। তার মানে, সহকর্মীরা তার অবস্থান সম্পর্কে জানে? যদি না-জানে, তাহলে এই লোক এই প্রশ্ন দিয়ে কী বোঝাতে চাইল?
সহকর্মীটি লক্ষ্য করল, তরুণ ব্যারিষ্টার কিছু না বলে রাগ-রাগ হয়ে একটা ভুট্টা ছাড়াচ্ছে; তাই উত্তরের আশা না-করেই তড়িঘড়ি করে বলল “না, মানে বলছিলাম যে, যদি না যাও, তাহলে তুমি চাইলে দিনটা আমাদের সঙ্গে কাটাতে পারো। তুমি বোধহয় জানো না, আমার একটা খুব আদরের বন্ধু আছে। অবশ্য, বন্ধু না বলে আমার আত্মা বলাটাই ভালো।”
কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগছিল তরুণের। নিমন্ত্রণ সে গ্রহণ করতে পারে, তবে এক শর্তে–তাদের দুজনকেই নিমন্ত্রণ করতে হবে।
সে-তো বটেই। নিমন্ত্রণ করলে তো দুজনকেই করবে। সে আবার ভিন্নকিছু আশা করেছিল নাকি? যাহোক, এভাবেই তাদের বন্ধু না-থাকার সমস্যা, আর ক্রিসমাস দিনের সমস্যা দুই-ই মিটে গেল।
ঠিক ছয়টার সময় ওরা নতুন বন্ধুদের ফ্ল্যাটে পৌঁছল। সবার ব্যবহার বেশ আন্তরিক। পুরুষ দুজন যখন ‘পাঞ্চ’ পান করল, নারী দুজন তখন রান্নাঘর সামলালো। খাবার সময় হলে চারজনে ধরাধরি করে টেবিল পাতলো। কিন্তু টেবিলটা একসাথে চারজন বসে খাবার মত যথেষ্ট বড় ছিল না। এটা-ওটা জোড়া দিয়ে বড় করার চেষ্টা করেও যখন লাভ হল না, তখন পুরুষ দুজন হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসল।
নারী দুজন কিন্তু ইতোমধ্যে বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। দুজনের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া হয়েছে। কারণ, তারা দুজনেই এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তাদের প্রতি সমাজের করা অভিন্ন কটুক্তিই এই বন্ধনের মূল। তারা নিজেরা অবশ্য একে-অন্যকে বেশ সম্মান দিয়ে কথা বলল, অন্যের অনুভূতিগুলোর যথার্থ মূল্যায়ণ করল। সেইসঙ্গে, সতর্কতার সাথে সব রকম বিতর্কিত প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে গেল। সাধারণত ছেলেমেয়েরা আশেপাশে না-থাকলে স্বামী-স্ত্রী যেসব বিষয়ে কথা বলে, বিবাহিত হওয়ার সুবাদে যেসব বিষয়ে কথা বলাকে নিজেদের অধিকার বলে মনে করে, সেসব বিষয়ও এরা সযত্নে এড়িয়ে গেল। এভাবে বেশ গুছিয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করল ওরা।
খাওয়ার পর্ব শেষে যখন পুডিং আনা হল, তখন তরুণ ব্যারিস্টার কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়ালো–এই সমস্ত আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানালো। প্রশংসার সুরে বলল, “সেটাই হচ্ছে প্রকৃত আনন্দ, যা-কিনা দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ছেড়ে, সমস্ত ঝামেলা থেকে বের হয়ে এসে, প্রকৃত বন্ধুদের সাথে করা হয়। কিন্তু কেন জানি হঠাৎ করে মেরী লুইসা(তরুণের বান্ধবী) কাঁদতে শুরু করল। কারণ জানতে চাইলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ব্যারিস্টার তার মা-বোনদের মিস করছে। লুইসার কথায় ব্যারিস্টার কিন্তু মোটেও খুশি হতে পারল না। সে জোর দিয়ে বললো, মা বোনদের সে মিস-ততা করছেই না, উপরন্তু, তারা যদি সবকিছু মেনেও নিত, তবুও সে আশা করত, এই সময় তারা দূরে থাকবে।
আচ্ছা! তাই যদি হবে, তবে সে লুইসাকে বিয়ে করছে না কেন?
অদ্ভুত! এর মধ্যে আবার বিয়ের কথা এল কোত্থেকে? তারা কি বিয়ের চেয়ে খারাপ আছে নাকি?
না, তা নয়। কিন্তু তারা যে সমাজ-স্বীকৃতভাবে বিয়ে করেনি সেটাও তো সত্য।
সমাজ-স্বীকৃত বিয়ে? মানে, পুরোহিতের দেয়া বিয়ে? ছিঃ! তরুণটি মনে করে, ও-বিয়ে কোন বিয়েই নয়; কারণ একটা মানুষ কতগুলো পরীক্ষা পাশ করে পুরোহিতের কাজ নিলেই তার মধ্যে কোন আধ্যাত্মিকতা ভর করে না। বিয়ে পড়ানোর সময় পুরোহিত যে মন্ত্রগুলো পড়ে, ওগুলো আসলে অর্থহীন-যুক্তিহীন নিছক কতগুলো বাজে কথা! আর এই বাজে কথাগুলোর জোরেই বিয়ে পবিত্র হয়ে যাবে?
তা না-হয় ঠিক আছে, লুইসাও হয়তো তা-ই মনে করে, কিন্তু তার মন যে মানতে চায় না। মনে হয় যেন কোথায় কী একটা গণ্ডগোল আছে! মানুষজন তার দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলে যে!
–বলুক, যার যা খুশি বলুক!
কিছুক্ষণ পর তরুণ ব্যারিস্টারের সাথে সোফিও গলা মেলালো। সে ইতোমধ্যে জেনে গেছে, ব্যারিস্টারের পরিবারের লোকজন তাদের সম্পর্ককে ভালো চোখে দেখে না। অতএব, সে মন্তব্য করল, “পরিবার পরিবারের জায়গাতেই থাকুক। প্রত্যেকের একটা নিজস্ব অবস্থান থাকে, সে অবস্থানের গণ্ডি অতিক্রম করা কারো জন্যই সমীচীন নয়।” ব্যারিস্টার এবং তার প্রেমিকা যেন খানিকটা সান্ত্বনা পেল এতে। আরও কিছুক্ষণ সেখানে। থেকে, গল্পগুজব করে, বেশ রাত্রি করে তারা নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরল।
ওরা এখন আগের চেয়েও বেশি সুখী। কারণ, এখন নতুন বন্ধু হয়েছে। সবকিছু নিয়ে ওরা এমন গোছালোভাবে থাকতে লাগলো যে, সমাজ-স্বীকৃত উপায়ে গঠিত অনেক পরিবারের চেয়ে ওদের সুখ বেশি বলে মনে হয়। দুজনের সেই বন্ধনহীন ভালোবাসা আগের মতই অটুট রয়েছে। প্রেমিক প্রেমিকার মত করেই দিন পার হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহজনিত কারণে যেসব ঝামেলা হয়, যেমন: একে-অন্যের সাথে রাগারাগি করা, ঝগড়াঝাটি করা, সেগুলো কখনোই ওদের মধ্যে হয় না।
*** *** ***
দু’-এক বছর একসাথে থাকার পর তাদের মিলন এক পুত্রসন্তানে আশীর্বাদপুষ্ট হল। অতএব, প্রেমিকার পদোন্নতি হল এবার সে এখন মা, এবং এই পরিচয়ের বাইরে অন্য সব কিছু সে মন থেকে মুছে ফেলল। সন্তান জন্মদানের সময় যে যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছে, আর জন্মদানের পর যে পরম মমতায় সন্তানকে লালন করতে হচ্ছে, সে অনুভূতিগুলোর গভীরতায় আগেকার স্বার্থপর অনুভূতিগুলো নিমজ্জিত হল। আগে সে মনে করত, জগতের সব ভাল জিনিস শুধু তার একার জন্য, অথচ, এখন স্বামীর(!), দুঃখিত, প্রেমিকের ভালোবাসায় ভাগীদার আসাতেও সে মোটেই দুঃখিত হল না। নতুন ভূমিকায় নিজেকে সে বন্ধুদের। চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ববান বলে ভাবতে শুরু করল। প্রেমিকের সঙ্গে আচার-আচরণ, মিলন, সবকিছুতে যেন আগের চেয়ে বেশি প্রত্যয় ফুটে উঠল।