কিছুক্ষণ পর সাইরেন শোনা যায়। জাহাজে সমবেত হবার সংকেত এটা। কিন্তু স্বামী সে সংকেত কানেই তোলে না। দুপুর একটা বাজার আগ পর্যন্ত স্ত্রীকে ছেড়ে কোথাও যাবার ইচ্ছে নেই তার।
কিন্তু এ কী হচ্ছে? সে চলে যাচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ, তাকে তো যেতেই হবে। জাহাজের সবার সাথে ভোরবেলার প্রার্থনায় একত্রিত হতে হবে যে।
ও আচ্ছা, এই কথা! তা ভোরের প্রার্থনা কখন শুরু হবে?
ঘড়ির কাটার ঠিক পাঁচটায়।
ওহহো! এত ভোরে? কিন্তু এই সারাটা রাত স্ত্রী একা-একা কোথায় থাকবে?
স্ত্রী কোথায় থাকবে সেটা স্ত্রীর ব্যাপার!
মনে মনে কিছু একটা ভেবে স্বামী বেশ মজা পেল। তারপর চট করেই স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলো, হোটেলের কোন্ রুমটা ভাড়া নেয়া হয়েছে। স্ত্রী গিয়ে সেই রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো। ভেতরে যেতে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার! স্বামী সন্তর্পণে কাছে এসে গা ঘেষে দাঁড়ালো–চুম্বনে চুম্বনে স্ত্রীর মুখ ভরিয়ে তুললো। তারপর হ্যাঁচকা টানে কোলে তুলে নিয়ে পায়ের ধাক্কায় দরজা খুলে ফেললো।
–ওয়াও! এত্ত বড় খাট! দেখেতো আস্ত একটা জাহাজ মনে হচ্ছে! এত বড় খাটের কী দরকার ছিল!
স্বামীর কথায় স্ত্রী লজ্জা-রাঙা হয়। অবশ্য চিঠি পড়েই তার পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছিল। তারা যে একসঙ্গে হোটেলে থাকবে সে সম্পর্কে সূক্ষ্ম একটা ইঙ্গিত চিঠিতে ছিল। এখন তার বাস্তবায়ন হচ্ছে। অতএব, স্বামী আপাতত ভোরের প্রার্থনার জন্য জাহাজে ফেরার চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলল।
–ধুর! এইসব প্রার্থনা ফার্থনায় কে যায়!
“ছি-ছি! ওভাবে বলতে হয় না। স্বামীর ঠোঁট চেপে ধরলো স্ত্রী। তারপর ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে বলল, “বিছানায় না-থেকে চল আমরা বসে বসে কফি খাই। বিছানাপত্র কেমন স্যাঁতসেঁতে মনে হচ্ছে।”
ঊহ! কী দুষ্টু হয়েছে বউটা, কোত্থেকে যে শেখে এসব দুষ্টুমি! ঠোঁটের ওপর রাখা স্ত্রীর হাতটা ধরে বুকের কাছে নিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি দেয় স্বামী “আচ্ছা! বুঝলাম, সবই বুঝলাম!”
না, মোটেই সব বোঝেনি, সে আসলে আস্ত একটা বোকা।
তাই নাকি? আসলেই বোকা? কিছুই বোঝে না? ঠিক আছে, দেখা যাক কতটুকু বোঝে!
আস্তে করে স্ত্রীর কোমরে হাত দিল স্বামী।
উঁহু, এসব কিন্তু মোটেই ঠিক হচ্ছে না; আচরণে আরও সংযত হওয়া উচিত।
–আচরণে সংযত! এত সোজা? …
ঘড়ির কাটায় যখন রাত দুটো বাজল, তখন পূব-আকাশে রক্তরাঙা সূর্য দেখা দিচ্ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে রাতের বেলা সূর্য ওঠে]। স্বামী স্ত্রী খোলা জানালায় বসে দৃশ্যটা উপভোগ করছিল। ওরা এখনো যেন প্রেমিক-প্রেমিকাই রয়ে গেছে, তাই না? হুম… কিন্তু অনেক হয়েছে, ক্যাপ্টেন সাহেবকে এবার উঠতে হবে। আবার দশটায় ফেরত আসবে সে। তখন একসঙ্গে নাস্তা করে দুজনে নৌকায় ঘুরতে বের হবে।
যাবার আগে স্বামী নিজ হাতে কফি বানাল। ওরা যখন পাশাপাশি বসে কফি খাচ্ছিল, তখন সবেমাত্র সূর্য উঠতে শুরু করেছে, গাংচিলের ডানায় নতুন দিনের আহবান। দূরের সমুদ্রে গানবোটগুলোকে দেখা যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন সাহেব বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। ঘড়ির কাটাগুলো এখন সূর্যের আলোয় চকচক করছে। নাহ্, আর একটুও দেরি করা যাবে না। কিন্তু যেতে যে মন চায় না! যাহোক, খানিক বাদেই আবার মিলনের সম্ভাবনায় এই আপাত-বিরহকে মেনে নিল ওরা। শেষবারের মত স্ত্রীকে চুম্বন করল স্বামী, তলোয়ার খাপে ভরল, তারপর ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে। গেল। ব্রিজের কাছে গিয়ে জাহাজে ওঠার ছোট নৌকাটাকে শিস দিয়ে ডাকল। স্ত্রী কিন্তু জানালায়ই দাঁড়িয়ে ছিল। পর্দা দিয়ে নিজেকে এমনভাবে আড়াল করে রেখেছিল, যেন দেখা দিতে ভীষণ লজ্জা লাগছে! ওদিকে নৌকা না-আসা পর্যন্ত স্ত্রীকে চুম্বন ছুঁড়ে দিচ্ছিল স্বামী। নৌকায় ওঠার সময় চিৎকার করে বলল–“ভালো করে ঘুমিয়ে, স্বপ্নে দেখা হবে।” নৌকা ছেড়ে দিল। স্বামী এবার দূরবীন দিয়ে স্ত্রীকে দেখার চেষ্টা করল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত, কালো-চুলে-জড়ানো একটা ছোট্ট শরীর দেখা যাচ্ছিল। সূর্যরশ্মি এসে পড়ছিল সেই মায়াবী শরীরটার ওপর। মনে হচ্ছিল যেন কোন কল্পনার মৎস্যকুমারী এসে জানালার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
যথাসময়ে তোপধ্বনি হল। রণভেরীর দীর্ঘ আওয়াজ চকচকে জলের ওপর দিয়ে গিয়ে ছোট ছোট দ্বীপ ছাড়িয়ে দূরের পাইন বন থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। জাহাজের সব নাবিক এসে ডেকের ওপর একত্রিত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ভোরের প্রার্থনা শুরু হলো। এমন সুন্দর সকালের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইবেল থেকে কিছু অংশ পড়ে শোনানো হলো।
দালাড়ো শহরের ছোট্ট গীর্জায় ঘণ্টা বাজতে শোনা গেল। রবিবারের ঘণ্টা। আজ সবকিছুই যেন কেমন ফুরফুরে। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়ায় চেপে সাগরের বুকে অগণিত ছোট ঘোট নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে, নানান রঙের নিশান সেগুলোতে। ব্রিজের ওপর মনের আনন্দে কপোত-কপোতী ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেলে নৌকার হাকডাকে চারপাশ মুখরিত; আর এই সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে, সূর্য যেন তরঙ্গ-সংকুল জলে নিজের সবটুকু জ্যোতি ঢেলে দিচ্ছে। এমন স্বর্গীয় পরিবেশে কী যেন কী মনে পড়ে যাওয়ায় স্ত্রীকে হঠাৎ লজ্জারাঙা হাসি হাসতে দেখা গেল।
দশটার সময় বারো জন নাবিক জাহাজ থেকে নামলেন। এদের মাঝে আমাদের ক্যাপ্টেন সাহেবও আছেন। অতএব, স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলন ঘটলো। হোটেলের বিশাল ডাইনিং রুমে ওরা একসাথে নাস্তা করতে বসল। ওদের হাবভাব দেখে আশপাশের টেবিলে নানান রকম কানাঘুষা চলতে লাগলো–“এরা কি সত্যিই স্বামী-স্ত্রী?” ওরা কিন্তু এতে বেশ মজাই পেল; স্বামীর প্রেমিকসুলভ আচরণ যেন আরও বেড়ে গেল। স্ত্রী অবশ্য একটু একটু লজ্জা পাচ্ছিল–একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসে, আবার ডিনার ন্যাপকিন দিয়ে একটুখানি খোঁচা দেয়।