শেষ পর্যন্ত ফ্রিদিওফকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হল। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিরাময় অযোগ্য রোগী হিসেবে ওকে আলাদা করে ফেলা হলো।
*** *** ***
সময় পেলেই ফ্রিদিওফ এখন জীবনের দিকে ফিরে তাকায়। পুরো জীবনকে একনজরে দেখতে চায়। সবাইকে নিয়েই চিন্তা করে নিজেকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে, সবকিছু নিয়ে। সবচেয়ে মন খারাপ হয় মেয়েদের কথা চিন্তা করলে ভবিষ্যৎ স্বামীকে না চিনে, তার প্রতি কোন ভালোবাসা না-থাকা সত্ত্বেও যেসব মেয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়, তাদের কথা চিন্তা করলে মনটা করুণায় ভরে যায়। ফ্রিদিওফ জানে এই অনুভূতি কতটা গভীর; কারণ, নিজের জীবন দিয়ে এ-অনুভূতির গভীরতা মেপেছে সে। এ-অনুভূতি এক অভিশাপের নামান্তর, যে অভিশাপ প্রকৃতির কোন নিয়ম ভঙ্গ করলে পেতে হয়। ফ্রিদিওফের বেলাতেও প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। তাই এখন তার সমস্ত দুঃখের কারণ হিসেবে সে পরিবারকে দায়ী করে–“সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, পরিবার কখনোই একটি শিশুকে যথাসময়ে স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দেয় না।”
স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই ফ্রিদিওফের–পবিত্র অনুশাসনের দোহাই দিয়ে বিয়ের নামে যেসব শর্তাবলী চাপিয়ে দেয়া হয়, সেগুলোর ভারে তার স্ত্রী-ও কি সমানভাবে জর্জরিত হয়নি?
বিবাহিত এবং অবিবাহিত
হেমন্তের এক চমৎকার সন্ধ্যায় স্টকহোমের হোপ গার্ডেনের পথে পায়চারি করছিল ব্যারিস্টার তরুণটি। পাশের প্যাভিলিয়ন থেকে টুকরো-টুকরো গানের সুর ভেসে আসছিল। সেই সাথে মস্ত জানালার ফাঁক গলে আলোর বন্যা আছড়ে পড়ছিল রাস্তার ওপরের গাছটায়। সে-গাছে তখন হলদে ফুলের ছড়াছড়ি। আলো আর ফুল মিলে এক অপূর্ব প্রতিচ্ছবির সৃষ্টি হয়েছে।
তরুণটি প্যাভিলিয়নের মধ্যে প্রবেশ করল। নিরিবিলি দেখে একটা টেবিলে বসে এক গ্লাস পাঞ্চ অর্ডার দিল। ইতোমধ্যে, সেখানে এক গায়কের অবির্ভাব ঘটল। একটা মৃত ইঁদুরকে নিয়ে লেখা খুব করুণ একটা গান গাইল সে। তাঁর পর এল এক তরুণী। উজ্জ্বল-গোলাপী-রঙের-জামা পরা তরুণীটি এসে একটা ড্যানিস গান গাইতে শুরু করল :
“জ্যোৎস্না ভরা রাতের চমৎকার যে ভ্রমণ
কোনকিছুই হয় না আনন্দের তেমন”
তরুণীটিকে দেখে সহজ-সরল বলেই মনে হল। গানটা সে ব্যারিস্টার তরুণটিকে উদ্দেশ করে গাইল। তাকে নিয়ে আলাদা করে এভাবে গান গাওয়ায়, তরুণটি বেশ লজ্জা পাচ্ছিল। তবে, খানিক গর্ববোধও হচ্ছিল তার। বলা যায়, একরকম ভালোই লাগছিল। যাহোক, কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের মধ্যে আলাপ জমে উঠল। এ আলাপের শুরু হয়েছিল এক বোতল মদ দিয়ে, আর শেষ হল দুই রুমের ঝাঁ চকচকে এক ফ্ল্যাটে গিয়ে। তরুণের অনুভূতি কেমন ছিল, কিংবা, ফ্ল্যাটের মধ্যে কী কী আসবাব আর সুযোগ-সুবিধা ছিলো তা পুরোপুরি বর্ণনা করা এ ছোটগল্পের সাধ্যাতীত। তবে, সর্বোপরি বলা যায়, ঐ দিনের পর থেকে তারা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল। অধুনা সমাজতান্ত্রিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, আর বান্ধবীকে সব সময় চোখে। চোখে রাখার বাসনায় তরুণটি সিদ্ধান্ত নিল, এখন থেকে সে ঐ ফ্ল্যাটেই থাকবে। আর ঘরদোর গুছিয়ে রাখতে তার বান্ধবী থাকবে ফ্ল্যাটের। তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে। বান্ধবীকে এতে বেশ খুশি বলেই মনে হল।
তরুণটির পরিবার কিন্তু এতে বাধ সাধল। তাদের মতে, সে অনৈতিক কাজ করে সবার মুখে চুনকালি দিয়েছে। অতএব, তাকে বকাঝকা করার জন্য বাবা-মা-ভাই-বোনদের সামনে তলব করা হল। কিন্তু তরুণের মনে হলো, সে এখন নিজে সিদ্ধান্ত নেবার মত যথেষ্ট বড় হয়েছে। সুতরাং, পরিবারের কথায় সে কোন রকম কর্ণপাত করলা না। ফলাফল যা হবার তা-ই হল: ‘পরিবারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ।
কিন্তু তরুণের জীবনে এর প্রভাব পড়ল উল্টোভাবে। ছোট্ট ফ্ল্যাটটিকে নিয়েই সে তার জগৎ কল্পনা করতে শুরু করল। একেবারে আদর্শ ঘরকুনো স্বামীতে(!), দুঃখিত, প্রেমিকে পরিণত হল। দুজনে বেশ সুখে সময় পার করছিল। একে অন্যকে প্রচণ্ড ভালোবাসত তারা, অথচ তাদের মধ্যে কোন আনুষ্ঠানিক বন্ধন ছিল না। ফলে, হারানোর ভয়টা সব সময়ই কাজ করত। আবার, এই হারানোর ভয় ছিল বলেই নিজেদের ভালোবাসাকে অটুট রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করত। বস্তুত, তারা ছিল দুই দেহ এক আত্না।
একটা জিনিসের অভাব অবশ্য ছিল–তাদের কোন বন্ধু ছিল না। সমাজের কারও তাদের প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না। ফলে, তারা কখনো কোথাও নিমন্ত্রিতও হত না।
*** *** ***
ক্রিসমাসের ঠিক আগের দিন।
যাদের এক সময় পরিবার ছিল, অথচ এখন নেই, তাদের জন্য এ দিনটা খুবই বেদনাদায়ক। সকালবেলা নাস্তার টেবিলে বসে তরুণটি একটা চিঠি হাতে পেল। বোনের চিঠি। ক্রিসমাসের দিনটা বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে কাটানোর জন্য অনুরোধ করেছে সে। চিঠি পড়ে তরুণ ব্যারিস্টার ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল, আগেকার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল–সে কি বান্ধবীকে একা ফেলে যাবে নাকি? অবশ্যই না। বাবা-মা এর আগেও বেশ ক’বার তাকে ছাড়া ক্রিসমাস পালন করেছে। অতএব, এবার বান্ধবীকে একা ফেলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
যা-হোক, মনের মধ্যে এ-জাতীয় নানা ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে সে কোর্টে চলে গেল।