“বাজা মেয়েদেরকে আসলে ভক্তিই করা উচিত! ঈশ্বরের অভিশাপগুলো সব ওরা নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে নেয় যে!”
এই মহিলারা কখনো চিন্তাও করত না, ঈশ্বরের অভিশাপ পুরুষের ঘাড়েও পড়তে পারে।
তবে ফ্রিদিওফের কোন সন্দেহ ছিল না, ঈশ্বরের অভিশাপ ওর ঘাড়েই পড়েছে। না-হলে জীবনটা কখনো এত বিবর্ণ, এত নিরানন্দ হতে পারে না। প্রকৃতি দুটি ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ তৈরি করেছে–পুরুষ আর নারী। এ ভিন্ন লিঙ্গের মানুষদের মাঝে কেউ কখনো শত্রু, কখনোবা বন্ধুর দেখা পায়। নিজেকে অভিশপ্ত এ-কারণেই মনে হয় যে, সে দেখা পেয়েছে শত্রুর এক ভীষণ শত্রু, যাকে কোনভাবেই সহ্য করা যায় না।
*** *** ***
একদিনের ছোট্ট একটা ঘটনা ফ্রিদিওফের শেষ শক্তিটুকুও কেড়ে নিল। বোনদের একজনের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ করে বোনটি জিজ্ঞেস করে উঠল,
–আচ্ছা, ‘খোঁজা’ কাকে বলে?
বোনটি আপনমনে সেলাই করছিল। বিশেষ কিছু বোঝানোর জন্য সে প্রশ্নটা করেনি। ফ্রিদিওফ প্রথমে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেও পরক্ষণেই সান্তনা নিলো–“ও হয়ত আসলেই শব্দটার অর্থ জানে না! হয়ত কোথাও কারোও মুখে শুনে প্রশ্ন জেগেছে, তাই জিজ্ঞাসা করেছে।” তবুও বুকের ভেতর কোথায় যেন চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করলো ফ্রিদিওফ। উত্তর পেতে দেরি হওয়ায় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল বোনটি। এবার সন্দেহের তীর এসে গায়ে বিধল। মনে হল, চারপাশের সবাই যেন আড়াল থেকে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। কোনদিকে না-তাকিয়ে হনহন করে বাইরে চলে গেল ফ্রিদিওফ। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে, রাগের মাথায়, কাজের মেয়েদের একজনকে ধর্ষণ করে বসল। ফলাফল পেতেও দেরি হল না। যথাসময়ে সন্তানের আগমন ঘটলো।
এবার, মানুষের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর অবস্থান উল্টে গেল। লুইসার প্রতি সবার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল, যেন সে বিশাল কোন আত্মত্যাগ করে ফেলেছে, আর ফ্রিদিওফ হলো ‘কুলাঙ্গার’, ‘দুশ্চরিত্র। কিন্তু এসবের কোনকিছুই ওকে স্পর্শ করল না। ও বরং মনে মনে ব্যাপারটার একটা যুতসই ব্যাখ্যা দাঁড় করালো–“এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, সন্তান না-হবার দোষটা আসলে তার নয়, সে নিখুঁত। আর, নিখুঁত হয়ে জন্মানোটা শুধু সৌভাগ্যেরই নয়, বিরাট সম্মানেরও ব্যাপার। তবে পুরো ব্যাপারটা লুইসার মধ্যে কেমন একটা ঈর্ষার ভাব জন্ম দিল। তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ঈর্ষাটা কীভাবে যেন ‘পতিভক্তি’র রূপ নিল। কিন্তু এ জাতীয় ভক্তি-ভালোবাসায় ফ্রিদিওফ আগের চেয়ে বরং বেশি বিরক্ত হলো। অবিরাম নজরদারি আর ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনধিকারচর্চা কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। মাঝে মাঝে এমনকি ভীষণ ছোটখাটো বিষয় নিয়েও লুইসা এমন ব্যাকুলতা দেখাতো যে, ফ্রিদিওফ মেজাজ খারাপ না-করে পারত না–“বন্দুকটা ভুলে লোড করা নেইতো?” কিংবা বাইরে যাবার সময়, “ওভারকোট পরেছেতো?” দৈনন্দিন বিষয় নিয়ে এ-জাতীয় বাড়াবাড়ি মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না ফ্রিদিওফের। ওর ঘরের প্রতিটি জিনিস ভীষণ পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা হত। সেই সাথে সারাদিনজুড়ে থোয়ামোছা তো আছেই! প্রতি শনিবার ঘরের সব জিনিসপত্র বাইরে বের করে কার্পেট পরিস্কার করা হত, কাপড়চোপড় রোদে দেয়া হত। এ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের যন্ত্রণায় ঘরে থাকার শান্তিটুকুও উধাও হল।
সারাদিনে করার মত তেমন কোন কাজ ছিল না ফ্রিদিওফের। কাজের লোকেরাই সব করে দিত। মাঝে কিছুদিন চাষবাস নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখল ওতে আরও উন্নতি করা যায় কি না। কিন্তু কয়েক দিন পরই হাল। ছেড়ে দিলো–যে মানুষ নিজের ঘরের উন্নয়ন করতে পারে না, সে বাইরের উন্নয়ন কী করবে?
একসময় পুরোপুরি হতোদ্যম হয়ে গেল ফ্রিদিওফ। কথাবার্তা বলা প্রায় ছেড়েই দিল; কারণ সে যা-ই বলার চেষ্টা করে তার-ই বিরোধিতা করা হয়। মনের মত কোনও বন্ধু-বান্ধবও নেই যার কাছে একটু হালকা হওয়া যায়। মাথার ভেতরটা সারাক্ষণ কেমন অসার হয়ে থাকে। আবেগ-অনুভূতিগুলোও আজকাল আর আগের মত কাজ করে না–কোনকিছুর প্রতিই কোন টান। অনুভব করে না। সব কিছু ভুলে শেষমেষ মদের নেশায় আসক্ত হলো ফ্রিদিওফ।
*** *** ***
ফ্রিদিওফ এখন বলতে গেলে বাড়িতেই ফেরে না। হরহামেশা ওকে বিভিন্ন হোটেলে বা ফার্মের মজুরদের ডেরায় মদ্যপ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। উঁচু-নিচু সব শ্রেণির মানুষের সাথে বসে মদ্যপান করে। সারাদিন মদের ওপরই থাকে। অপরিচিত মানুষের সাথে অনর্গল কথা বলতে ভালো লাগে ওর। আর এর সুবিধার্থে মদ্যপান করে মস্তিষ্ককে উত্তেজিত রাখে। ঐসব মানুষের সাথে বেশি বকবক করে যারা কখনো কোন ব্যাপারে বিরোধিতা করে না। তবে শুধুমাত্র এ-জাতীয় মানুষের সাথে বকবক করার সুবিধার্থেই, নাকি নিছক মাতাল হওয়ার জন্য, ঠিক কোন কারণে যে সে মদ্যপান করে তা বলা মুশকিল।
বাড়ির টাকা-পয়সার হিসাব নারী সম্প্রদায়ের কাছেই থাকে। ফলে টাকা জোগাড় করতে ফার্মের জিনিসপত্র বেচতে শুরু করল ফ্রিদিওফ। শেষ। পর্যন্ত নিজের সিন্দুক থেকেও জিনিসপত্র সরাতে লাগলো।
ইতোমধ্যে বাড়িতে একজন নতুন কেয়ারটেকার রাখা হয়েছে। আগের কেয়ারটেকারকে অসংলগ্ন আচরণের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে। নতুন লোকটা ভীষণ গোঁড়া। চার্চে নিয়মিত যাতায়াত তার। এখানে এসেই স্থানীয় পাদ্রিদের সহায়তায় মদের দোকানের লাইসেন্স বাতিল করিয়েছে। এতে ফ্রিদিওফ পড়লো মহা ফাঁপরে নতুন আখড়া খুঁজতে হল। অবশ্য পেতেও খুব-একটা দেরি হল না–ফার্মের মজুরদের ডেরায় বসে গেল। একের পর এক নতুন নতুন কেলেঙ্কারি রটতে লাগলো। ফ্রিদিওফ ওসবের তোয়াক্কা করে না। দিনে দিনে ও এমন পাড় মাতাল হয়ে গেল যে মদ্যপান করতে না-দিলে শরীরে খিচুনি শুরু হয়ে যায়।