হঠাৎ করেই সম্বিত ফিরে পেল ফ্রিদিওফ–বাড়ি ফিরতে হবে, আজ তার বিয়ের প্রথম সকাল। কিন্তু বাড়ি ফিরলে সবাই যে দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করবে, সেটা মনে করেই নিজেকে অপরাধী মনে হল। যেন সভ্যতার বিরুদ্ধে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে, ঘোরর কোন অন্যায় করে ফেলেছে। “ইস! এই পৃথিবী ছেড়েছুঁড়ে যদি ভিন্ন কোথাও চলে যাওয়া যেত! কিন্তু সেটাই বা কীভাবে সম্ভব?” এই জাতীয় নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে-খেতে ক্লান্ত করে তুলল ফ্রিদিওফকে। কিছুক্ষণ পর ভীষণ ক্ষুধা অনুভব করলো–“নাহ্! বাড়ি ফিরতে হবে, ব্রেকফাস্ট করতে হবে।”
বাড়ির গেটে এসে হতভম্ব হয়ে গেল ফ্রিদিওফ। মনে হল, যেন ওকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য গোটা বাড়ির অতিথিরা গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখামাত্র সবাই চিৎকার করে উঠল। এলোমেলো পা ফেলে বাড়ির দুয়ার পার হলো ফ্রিদিওফ। এদিক-ওদিক থেকে নানাজন, নানাভাবে, ‘শরীর কেমন আছে?’ জিজ্ঞেস করে হাসি-ঠাট্টা করছিল। কিন্তু ফ্রিদিওফ এসবের কোন কিছুতেই কান না-দিয়ে, মুখ ফিরিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। লক্ষ্যই করল না, সবার মাঝে ওর স্ত্রী-ও ছিল। হয়তো আশা করেছিল, ফ্রিদিওফ এসে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করবে!
খাবার টেবিলে বহুমুখি যন্ত্রণা সহ্য করতে হল। এ-এমনই যন্ত্রণা, মনে হল যেন অনন্তকাল দগ্ধ হতে হবে। অতিথিদের চটুল কথাবার্তা, আর ‘বিজ্ঞ পরামর্শে গা জ্বলতে থাকল। এর মধ্যে আবার যোগ হল লুইসার গায়েপরা ন্যাকামি! সবমিলিয়ে, যে-দিনটা জীবনের সবচেয়ে আনন্দের হতে পারতো, সেটাই আজ ফ্রিদিওফের জন্য সবচেয়ে জঘন্য দিনে পরিণত হল।
*** *** ***
কয়েক মাসের মধ্যেই নববধূ বাড়িতে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলল। এ ব্যাপারে ফ্রিদিওফের খালা আর বোনেরা হল তার বিশ্বস্ত সহযোগী। ফলে ফ্রিদিওফ বরাবরের মতই বাড়ির সবচেয়ে নিগৃহীত সদস্য হয়ে রইল। কালেভদ্রে অবশ্য, এটা-ওটা নিয়ে ওর পরামর্শ চাওয়া হত, কিন্তু সে পর্যন্তই পরামর্শের বাস্তবায়ন হত না কখনোই। এমন আচরণ করা হত যেন ও এখনও সেই শিশুটিই আছে!
ফ্রিদিওফের সঙ্গে একা বসে খাওয়াটা কিছুদিনের মধ্যেই লুইসার কাছে অসম্ভব বলে মনে হতে লাগলো। কারণ খাবার টেবিলে ফ্রিদিওফ ইচ্ছে করেই ভীষণরকম নীরব থাকত। এরকমটি সহ্য করা লুইসার পক্ষে সম্ভব ছিল না। খাবার টেবিলে নানারকম গপ্পো করার অভ্যাস ছিল তার। অতএব, অচিরেই খাবার টেবিলে ফ্রিদিওফের বোনদের একজন এসে জুটলো। এহেন নানাবিধ যন্ত্রণায় জীবনটা কেমন বদ্ধ হয়ে গেল। একাধিকবার নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলেও প্রতিপক্ষের সামর্থ্যের বিপরীতে সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হল। প্রতিপক্ষ সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায় এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওরা এমনভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলত যে, অস্থির হয়ে ফ্রিদিওফকে বনে পালিয়ে বাঁচতে হত।
রাত্রিগুলো ছিল সাক্ষাত আতঙ্ক! শোবার-ঘর জায়গাটাকে রীতিমত ঘৃণা করত ফ্রিদিওফ। ওটাকে মনে হত যেন ফাঁসির মঞ্চ! ধীরে-ধীরে ও আরও বেশি খিটখিটে হতে থাকল। আশেপাশের সবাইকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল।
বিয়ের এক বছর পার হল। তখনও সন্তান হবার কোন লক্ষণ নেই মায়ের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ। একদিন ফ্রিদিওফকে এককোনে ডেকে নিলেন তিনি,
–“তোমার কি ছেলের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না?” মায়ের গলাটা মিনমিনে শোনালো।
–“অবশ্যই করে” ফ্রিদিওফের জোরালো জবাব।
–“কিন্তু… কিন্তু তুমি বোধহয় তোমার স্ত্রীর সঙ্গে খুব-একটা ভালো ব্যবহার করছ না।” যতটা সম্ভব অস্বস্তি এড়িয়ে, আলগোছে কথাগুলো বলে ফেললেন মা।
এবারে ফেটে পড়ল ফ্রিদিওফ।
–“কী বলতে চান আপনি? আমার দোষ? আপনি কি চান আমি সারাদিন এসব নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করি! লুইসাকে চেনেন না আপনি? ওর স্বভাব জানেন না? এগুলো কি শুধু আমার একার দায়িত্ব? আপনি এমন পক্ষপাতিত্ব করলে আমার পক্ষে কোন জবাব দেয়া সম্ভব না!”
কথাগুলো মায়ের মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে বাইরে চলে গেল ফ্রিদিওফ। তবে মা কিন্তু সময় পেলেই ওই একই অভিযোগ করেন।
ধীরে-ধীরে ফ্রিদিওফ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ল, ভীষণ একাকীত্ব গ্রাস করল। শেষমেষ, বন্ধুত্ব পাতাললা বাড়ির কেয়ারটেকারের সাথে। কেয়ারটেকার লোকটা বয়সে তরুণ। মদ আর জুয়ায় দারুণ আসক্তি। অভ্যাসগুলো রপ্ত করতে ফ্রিদিওফেরও সময় লাগলো না। ফলে কেয়ারটেকারের রুমেই আজকাল বেশিরভাগ সময় কাটে। রাতে ঘরে ফেরে অনেক দেরি করে। এভাবেই দিন ফুরায়।
এক রাতে বাড়ি ফিরে দেখলো স্ত্রী তখনও জেগে আছে–ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
–“কোথায় গিয়েছিলে?” কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল স্ত্রী।
–“সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার।” স্ত্রীর প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল ফ্রিদিওফ। স্ত্রীও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়,
–বিয়ের পর স্বামী না-থাকাটা খারাপ না! অন্তত, একটা সন্তান যদি থাকত!
–সেটা কি আমার দোষ?
–নয়তো কি আমার?
কার দোষ আর কার নয়, তা নিয়েই এক তুলকালাম কাণ্ড বাঁধলো। শুরু হলো বাকবিতণ্ডা, কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে রাজি নয়! যেহেতু দুজনেই ভীষণ একগুঁয়ে, কেউই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে গেল না। অতএব, যা হবার তা-ই হলো, বিবিধ মতের বিবিধ কানাঘুষা! স্বামীকে নিয়ে মানুষজন চটুল রসিকতা করে, আর স্ত্রীকে সহ্য করতে হয় অসহ্য গঞ্জনা। আশেপাশের মহিলারা স্বামীর কানে বিষ ঢালে, টিপ্পনী কাটে