ফ্রিদিওফের শর্তাবলী সানন্দে গৃহীত হল। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হতেও দেরি হল না।
লুইসাকে ডেকে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানানো হল। সেসময় ফ্রিদিওফও সেখানে উপস্থিত ছিল। হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ওরা দুজনেই কেন যেন কান্না করে দিল! আবার যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমন হঠাৎ করেই কান্নাকাটি থেমেও গেল। এ-নিয়ে দুজনে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সারাদিন আর কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারল না। সবকিছু স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় নিল। ওদিকে খালা-বোনদের দরদ দিন দিন উথলে পড়ছে। কী ছেড়ে কী করবে তার কোন হিসেব নেই। বাড়ির দরজা-জানালায় নতুন রং পড়ল, ঘরদোর গোছগাছ হল, আরও কত কি! আর, এ সব হল ফ্রিদিওফের সঙ্গে ন্যূনতম আলোচনা বা পরামর্শ ছাড়াই।
বিয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন। যেখানে যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আছেন সবাইকে দাওয়াত করা হল এবং…
এবং বিয়ে সম্পন্ন হল।
*** *** ***
বিয়ের প্রথম সকালে খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠল ফ্রিদিওফ। বিছানা বালিশ ছেড়ে যত দ্রুত সম্ভব বাইরে বের হল। এমন একটা ভাব যেন বাইরে ভীষণ জরুরি কোন কাজ পড়ে আছে। লুইসা তখনও ঘুম থেকে না
উঠলেও সঙ্গোপনে সব কিছুই লক্ষ্য করছিল। ফ্রিদিওফের ঠিক বেরোবার মুখে পেছন থেকে বলে উঠল
“১১টায় ব্রেকফাস্টের কথা ভুলো না কিন্তু।” কথাগুলো অনেকটা আদেশের মত শোনালো।
শোনার ভান করে নিজের পড়ার রুমে গেল ফ্রিদিওফ। শু্যটিং স্যুট আর ওয়াটারপ্রুফ জুতা পরল। তারপর, খুব সাবধানে ওয়্যারড্রোব থেকে নিজের বন্দুকটা বের করে নিল–এ জিনিসটার কথা এতদিন সে গোপনই রেখেছে। সবকিছু বেশ গুছিয়ে নিয়ে বনের পথে হাঁটা ধরলো।
সময়টা অক্টোবর মাস। চারপাশ সাদা বরফে ঢাকা পড়েছে। ফ্রিদিওফ বেশ দ্রুত হাঁটছে। দেখে মনে হচ্ছে, যেন কোন পিছুটান এড়িয়ে পালাতে চাইছে। তবে সকালের নির্মল বাতাস কিছুক্ষণ পর ওর মনোভাবে পরিবর্তন আনল। ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করল ফ্রিদিওফ। বেশ তরতাজা লাগছে এখন। নিজেকে একজন পূর্ণ-স্বাধীন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। কারণ এই প্রথম তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন–বন্দুক নিয়ে বাইরে। যাওয়া–সত্যি হল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এই আপাত-স্বাধীনতার ভাব ফিকে হয়ে এল। এতদিন পর্যন্ত অন্তত একান্ত ব্যক্তিগত একটা শোবার ঘর ছিল, দিনের বেলা ওখানে বসে চিন্তা-ভাবনা করা যেত, রাতের বেলা সেখানে স্বপ্নেরা হানা দিত। এখন যে সেটুকুও অবশিষ্ট রইল না! আরেকজনেরর সঙ্গে শোবার ঘর ভাগ করে নেয়ার চিন্তাটা খুব বাজে লাগে। পুরো ব্যাপারটাকে কেমন একটা নোংরামি বলে মনে হয়। মানব চরিত্রের। বুনো বৈশিষ্ট্যটাকে এভাবে উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা কখনো কল্পনাও করেনি ফ্রিদিওফ। কারণ ও বেড়ে উঠেছে অনেকগুলো আদর্শকে সামনে রেখে। নিজের পরিবারের ভেতর এমনটা কখনো হতে দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কী, সংসার জিনিসটা ও কখনো কাছ থেকে দেখেইনি। তাই, একজন পুরুষ এবং একজন নারীর একসঙ্গে থাকার চিন্তাটা ওর কাছে নৈতিকতার স্পষ্ট স্থলন বলে মনে হয়। এ যেন লজ্জা-শরমের আবরণকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা, সমস্ত পেলবতাকে ছুঁড়ে ফেলা, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে ধ্বংস করা। এমনকি বিয়ে করা সত্ত্বেও, নারী-পুরুষের মিলনকে সে কিছুতেই মন থেকে মেনে। নিতে পারছে না। এ-তো মিলন নয়, এ-তো দুটো মানুষের মধ্যে নিছক নোংরামি! ফ্রিদিওফের মনে হল, এই জংলি ব্যাপারটার ভয় থেকেই হয়ত ‘নারীত্ব’ চিন্তাটার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে কি এ কথা খাটে? যদি ডাক্তারের মেয়ে কিংবা সেই মালির মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হত, তাহলে কি সেখানে ভয় বলে কিছু থাকত? বরং, একাকী তাকে কাছে পাওয়াটাকে এক ধরনের আশীর্বাদ বলে মনে হত। তখন তাদের মিলন শুধু ‘জৈবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যম না হয়ে, আত্মিক বোঝাপড়ার আনন্দে উদ্বেলিত হতে পারত। আফসোস! লুইসার সঙ্গে এগুলোর কোনটাই সম্ভব নয়। এমনকি, ওর সঙ্গে একা দেখা করার চিন্তাটার মধ্যেও কেমন বিশ্রী একটা নিরাসক্ততা আছে।
এ-জাতীয় এলোমেলো চিন্তা করতে করতে বনের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতে লাগত ফ্রিদিওফ। কী শিকার করবে, কীভাবে শিকার করবে, কোন কিছুই মাথায় এল না। শুধু মনে হচ্ছিল–একটা গুলির আওয়াজ হবে, আর কিছু একটা মারা পড়বে। কিন্তু, মরার জন্য কোন কিছুই বন্দুকের সামনে এল না। মনে হচ্ছে, যেন হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই পুরো বনটা পাখিশূন্য হয়ে গেছে, অন্য কোন জন্তু-জানোয়ারও নেই। সহসা একটা কাঠবিড়ালী চোখে পড়ল। সুড়সুড় করে পাইনগাছে উঠছিল, এক ফাঁকে ফ্রিদিওফের দিকে চকচকে চোখে চেয়ে, আবার সুরুৎ করে ছোট্ট লাফ দিল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার চেপে দিল ফ্রিদিওফ–ব্যর্থ প্রচেষ্টা। কাঠবিড়ালীটা এর মধ্যেই অন্যপাশে চলে গেছে। ফলে, গুলিটা গিয়ে গাছের গায়ে বিধে রইল। একটা লাভ অবশ্য হল–গুলির আওয়াজের পর কিছুক্ষণের জন্য চারপাশে এক ধরনের নিস্তব্ধতা তৈরি হল, পুরো বন যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রিদিওফ খুব উপভোগ করলো ব্যাপারটাকে, লম্বা করে শ্বাস নিলো। তারপর, হাঁটাপথ ছেড়ে হনহন করে বনের আরও গহীনে পা বাড়ালো। পথিমধ্যে যত ছত্রাক, ব্যাঙের ছাতা বা ছোটখাটো গাছপালা পড়ল সব দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে ফেললো। ফ্রিদিওফের ওপর যেন কিছু ভর করেছে আজ! সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোন সাপ কী এ-জাতীয় কিছু যদি চোখে পড়ে, তাহলে পায়ের তলায় খুব করে পিষে মারবে ওটাকে; না-হলে গুলি করে শেষ করে দেবে, তাতে যদি গায়ের জ্বালা জুড়ায়!