-”আস্তিক-নাস্তিক জানি না, কিন্তু জাগতিক মোহকে পাশ কাটিয়ে, খোলা মনে চিন্তা করতে পারেন, এমন মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি।” বেশ দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বলল ফ্রিদিওফ।
–ঠিক আছে, এসব না-হয় বাদ দিলাম। কিন্তু তুমি কি ভুলে গেছ, অন্য জায়গায় তোমার বিয়ে ঠিক করা আছে?
–“মানে কী?” আকাশ থেকে পড়ল ফ্রিদিওফ। “আপনি কি…?”
–হ্যাঁ, লুসিয়ার কথাই বলছি। লুসিয়াও মনে মনে তোমাকে পছন্দ করে।–আমাদের খালাতো বোন লুসিয়া!
মায়ের মুখে হাসি ফুটলো–“তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, ছোটবেলায় তোমরা যখন একসঙ্গে খেলা করতে, তখন একে-অন্যকে বাগদত্তা বলে ভাবতে?”
–কক্ষনো না! আমি কক্ষনো এসব ভাবিনি; বরং, আপনারাই আমাদেরকে এক সাথে খেলতে পাঠিয়েছেন, আর মনে মনে এসব চিন্তা করেছেন।
হঠাৎ করেই মায়ের সুর বদলে গেল, গলায় মিনতি ঝরে পড়ল। “তোমার বুড়ি মা আর বোনদের কথা একবার ভাবো, ফ্রিদি! আমরা সবাই মিলে এতদিন ধরে একটু-একটু করে নিজেদের মত যে পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছি, তার মধ্যে তুমি অপরিচিত কাউকে আনতে চাও? হঠাৎ করে বাইরে থেকে কেউ এসে আমাদের ওপর খবরদারি করলে সেটা মানতে পারবে?
–ও আচ্ছা! আপনারা তাহলে সব দিক চিন্তা করেই লুসিয়াকে বাড়ির কত্রী বানাতে চাইছেন!
–না! কাউকে বাড়ির কত্রী বানাতে চাইছি না। তবে, ছেলের ভবিষ্যৎ স্ত্রী পছন্দ করার অধিকার একজন মায়ের অবশ্যই আছে। আর, এক্ষেত্রে লুসিয়া ছাড়া অন্য কাউকে আমার অতটা উপযুক্ত মনে হয় না। আমার পছন্দে তোমার ভরসা নেই, ফ্রিদি? তোমার কি কখনো মনে হয়েছে, মা তোমার খারাপের জন্য কিছু করবে?
–ভালো-খারাপের কথা এটা নয়। আমি আসলে বলতে চাইছি, ছোটবেলা থেকেই লুসিয়াকে নিজের বোনের মত দেখে আসছি। ওকে আমি কখনোই অন্য দৃষ্টিতে দেখতে পারবো না, ভালোবাসতে পারবো না।
–ভালোবাসা? ভালোবাসার মত অনিশ্চিত জিনিস জগতে আর দ্বিতীয়টি নেই, মুহূর্তের বাতাসেই এটি উবে যায়। তাই ভালোবাসার ওপর। আস্থা রাখা নিতান্ত বোকামি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, ধর্মীয় আচরণ, সমমানসিকতা আর দীর্ঘদিনের পরিচয়, এই ব্যাপারগুলো একটা সুখী দাম্পত্য জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। এর সবগুলো গুণ লুসিয়ার মধ্যে আছে। ও তোমার জীবনকে ভরিয়ে তুলবে। তুমি যেভাবে চাইবে ওকে নিয়ে সেভাবেই জীবন গড়ে তুলতে পারবে।
ফ্রিদিওফের সামনে একটাই পথ খোলা ছিল–মায়ের কাছে সময় চেয়ে নেয়া। অগত্যা, সে তা-ই করল। চিন্তা-ভাবনার কথা বলে মায়ের থেকে কিছুদিন সময় চেয়ে নিল। ইতোমধ্যে, বাড়ির সবাই যেন রাতারাতি সুস্থ হয়ে উঠল! ফলে, ডাক্তার ভদ্রলোকের এ-বাড়িতে আসা বন্ধ হল। তবুও, হঠাৎ কেন যেন তাঁকে একদিন ডাকা হল। আসার পর ভদ্রলোক বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লেন–সবার ব্যবহারে স্পষ্ট অবজ্ঞা। মানুষ। হিসেবে তিনি যথেষ্ট বিচক্ষণ–মূল ঘটনা বুঝতে তাঁর মোটেও সময় লাগল না। তাই কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেন। পেছন থেকে ফ্রিদিওফ ডাকলেও, না-শোনার ভান করলেন। এভাবেই, দুই পরিবারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতি ঘটলো।
ফ্রিদিওফ কেমন ঝিমিয়ে পড়ল।
ওদিকে, নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বাড়ির ভেতর নানা অদ্ভুত কর্মকাণ্ড শুরু হল। ফ্রিদিওফের ওপর খালাদের ভালোবাসা ঝরে পড়তে শুরু করল। এমনভাবে তারা যত্নআত্তি শুরু করল যেন ফ্রিদিওফ নিতান্ত নাদান শিশু, আর তাদের দেখভাল ছাড়া ওর পক্ষে বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়! বোনদের আচরণেও লক্ষণীয় পরিবর্তন–তারাও বেশি বেশি যত্নআত্তি করার জন্য একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল! আর, এতকিছুর সমানতালে লুইসারও নিজের পোশাকআশাকের প্রতি সচেতনতা বাড়তে থাকল। সে এখন বেশ আটোসাটো জামা পড়ে, বেণি করে চুল বাঁধে। সুন্দরীতে তাকে কোনওমতেই বলা যায় না; তবে তার চোখ দুটো বেশ শান্ত, সে কথা সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে–তার বাকপটুতা!
ফ্রিদিওফ আগের মতই উদাস হয়ে রইল। যতদিন লুইসার ব্যাপারে কোন চিন্তা ছিল না, ততদিন সে কখনোই লুইসাকে একজন পুরুষ মানুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখেনি। কিন্তু ঐদিন মায়ের সাথে কথা বলার পর থেকে লুইসাকে দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগে; বিশেষ করে, যখন মনে হয় লুইসা যেন গায়ে পরে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। ফ্রিদিওফ যেখানেই যায় সেখানেই লুইসার সঙ্গে দেখা হয়–সিঁড়িকোঠায়, বাগানে, এমনকি ঘোড়ার আস্তাবলেও! একদিনতো সকালবেলা ওর রুমের মধ্যেই এসে হাজির। ফ্রিদিওফ তখনও বিছানা ছাড়েনি। লুইসা এসে এমন ভাব করল যেন তার মোটেই আসার ইচ্ছা ছিল না। লাজুক-লাজুক ভাব দেখিয়ে ফ্রিদিওফের কাছে একটা সেফটিপিন চাইল! ফ্রিদিওফ শুরুতে বুঝতেই পারলো না ঘটনা কী। চোখ রগড়ে নিয়ে দেখল লুইসা একটা ড্রেসিং জ্যাকেট পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে! দেখে রীতিমত হতভম্ব হয়ে গেলেও সেটা প্রকাশ না করে, কেবল মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলো। এ-জাতীয় নানা কারণে লুইসার প্রতি একরকম বিতৃষ্ণা অনুভব করছিল ফ্রিদিওফ; কিন্তু ওকে মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতেও পারছিল না। ওদিকে, মা ছেলের মধ্যে একের-পর-এক বৈঠক চলছিলো। সাথে খালা আর বোনদের নানা উৎসাহ-উদ্দীপনাতো আছেই। সব মিলিয়ে ফ্রিদিওফের জীবনটা যেন মস্ত এক বোঝায় পরিণত হল, যেন চারদিক থেকে একটা জালে আটকা পড়ে গেছে। এ জাল ছিন্ন করে বেরোবার পথ তার জানা নেই। লুইসাকে এখন বোন বা বান্ধবী কোনটাই মনে হয় না, আবার ভিন্ন কিছুও মনে করতে পারে না। তবে সারাক্ষণ ওর সাথে বিয়ের কথা শুনতে শুনতে এতদিনে মনে হয়েছে–“হ্যাঁ, লুইসা একজন নারী। যদিও এক অসহ্য নারী, তবু সত্যি কথাটা হচ্ছে, সে নারী। হয়তো ওর সাথে বিয়ে হলে হতেও পারে। যদি সত্যিই হয়, তবে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন হবে। হয়তো নতুন সম্পর্কটা হবে আবেগ-অনুভূতিহীন শুধুই একটা বন্ধনের মত।” এসব নানা চিন্তায় বুঁদ হয়ে রইল ফ্রিদিওফ। বাড়ির আশেপাশে আপাতত কোন তন্বী-তনয়া ছিল না। অতএব, ওর চিন্তাগুলো বুদবুদের মত উড়ে যেতেও খুব বেশি সময় লাগলো না–“লুইসাও হয়ত আর দশটা মেয়ের মতই হবে।” এবারে ফ্রিদিওফই আগে মায়ের কাছে গেল–“বিয়ে আমি করতে পারি, তবে শর্তসাপেক্ষে: বাড়ির একাংশের পুরো কর্তৃত্ব আমার হাতে থাকবে, আমি যেভাবে চাইব সেভাবেই চলবে; আর আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে কেউ হাত দিতে পারবে না।” এরপর ফ্রিদিওফকে কিছুটা নির্ভার মনে হল। ফিরে আসার সময় আরও জানালো, বিয়ে নিয়ে আর কোন কথাই সে বলবে না, মাকেই পরবর্তী সকল পদক্ষেপ নিতে হবে।