*** *** ***
সম্প্রতি বাড়ির বাগানে নতুন মালী রাখা হয়েছে। কাজের মেয়েরা যাতে কোন ঝামেলায় না পড়ে সেজন্য বুদ্ধি করে একজন বিবাহিত লোককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কোন দিক থেকে আসে তা কি আর কেউ বলতে পারে? নতুন মালীর বিয়ের বয়স অনুযায়ী তার পক্ষে কোন সুন্দরী তরুণীর বাবা হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। সুতরাং, বাগানের সমস্ত গোলাপের মাঝে হঠাৎ করেই একদিন এক ফুটন্ত গোলাপের দেখা পেল ফ্রিদিওফ। সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত প্রেমাবেগ পাখনা মেলে দিলো। মেয়েটা যেমন সুশ্রী তেমন শিক্ষিত। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেল ফ্রিদিওফ। ফলে শীঘ্রই ওর জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এল। এখন ওকে যখন-তখন বাগানে দেখা যায়। মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য সবসময়। তক্কেতক্কে থাকে। কিন্তু মেয়েটা তেমন গা করে না। তবে এর ফলাফল হল বিপরীত–মেয়েটার আপাত-অবহেলা ফ্রিদিওফকে আরও বেশি আগ্রহী করে তুললো।
একদিন ঘোড়ায় চড়ে বনের মধ্যে ঘুরছিল ফ্রিদিওফ, মাথায় ঘুরছিল মেয়েটার চিন্তা। ও ধরেই নিয়েছিল, কোন মেয়ে এতটা নিখুঁত কখনো হতে পারে না। মেয়েটার সঙ্গে একাকী দেখা করার ইচ্ছা ওকে পাগল করে তুলছিল। এতে যে কেউ খারাপ ভাবতে পারে তা মাথায়ই ছিল না। চিন্তাভাবনার উন্মত্ততায় এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল যে, মেয়েটাকে ছাড়া জীবন অসম্ভব ঠেকছিল। হালকাভাবে ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছিল। ফ্রিদিওফ, ফলে ঘোড়াটা ইচ্ছেমত এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করতে পারছিল। হঠাৎ, কোথা থেকে যেন একরাশ আলোর ঝলক খেলে গেল গাছের আড়ালে মালীর মেয়েকে দেখা গেল। ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল মেয়েটা; দেখে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল ফ্রিদিওফ। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে, চট করে ঘোড়া থেকে নেমে, মাথার হ্যাট খুলে, মেয়েটার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো। ঘোড়ার লাগাম হাতে ধরে রেখে এটা-সেটা নানান কথার ছুঁতোয়, ফিসফিস করে নিজের ভালোবাসার কথা জানাতেও ভুল করলো না। অথচ মেয়েটা কিন্তু শুরুতেই হতাশ করল। কষ্টজড়ানো কণ্ঠে। বলল,”এসব চিন্তা অবাস্তব, মিস্টার ফ্রিদিওফ”।
“কোনটা অবাস্তব?” গর্জে উঠলো ফ্রিদিওফ
–আপনার মত একজন ধনী ভদ্রলোক আমার মত গরীব ঘরের একটা মেয়েকে বিয়ে করবে, এই পুরো চিন্তাটাই অবাস্তব।
কেন যেন কথাগুলো মেয়েটার মুখে খুব বাস্তবসম্মত লাগছিল। ফলে, ফ্রিদিওফ একেবারে মুষড়ে পড়ল। ও জানে, মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে, এ ভালোবাসাকে সসম্মানে বাড়িতে স্থান, দেয়াটা অনেকটা দিবাস্বপ্নেরই মত। কারণ বাড়িতে নারীকুল যে গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে, সেখানে ভালোবাসার কোন স্থান নেই। ওরা কখনোই ভালোবাসার মূল্য বুঝবে না, হয়তো ফ্রিদিওফের ভালবাসাকে ওরা ছিঁড়েখুঁড়েই ফেলবে।
মেয়েটার সাথে কথপোকথনের পর থেকে ফ্রিদিওফ যেন বাকশক্তিহীন হয়ে গেল। প্রচন্ড হতাশা গ্রাস করল ওকে। ওদিকে, শরৎকাল আসতে-না আসতেই বাগানের মালী চাকরি থেকে অব্যাহতি চাইল। কোনওরকম কারণ না জানিয়েই সে ফ্রিদিওফদের এলাকা ছেড়ে চলে গেল। পরবর্তী দু’সপ্তাহ ফ্রিদিওফ কোনভাবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারল না। জীবনের প্রথম প্রেম, একমাত্র ভালোবাসাকে হারিয়েছে সে। প্রতিজ্ঞা করল, আর কখনোই ভালোবাসায় জড়াবে না।
এভাবেই, ধীরে ধীরে শরঙ্কাল চলে গেল। দরজায় দাঁড়ালো শীত। এবার ক্রিসমাসে এক নতুন প্রতিবেশী পেল ফ্রিদিওফরা। ভদ্রলোক পেশায় একজন চিকিৎসক। তাঁর ছেলেমেয়েরা বেশ বড় বড়। ফ্রিদিওফের বাড়ির মহিলারা যেহেতু সারাবছরই অসুস্থ থাকেন, দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব জমতে সময় নিল না। বলে রাখা ভালো, ভদ্রলোকের সন্তানদের মধ্যে এক সদ্যযৌবনা কন্যাও ছিল। অচিরেই ফ্রিদিওফ তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করল। শুরুতে সে খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল–মনে হচ্ছিল, এটা তার প্রথম প্রেমের সঙ্গে স্পষ্ট প্রতারণা। কিন্তু সময়ে সে এক ভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছল। তার মনে হল, ভালোবাসা বিষয়টা আসলে নৈর্ব্যক্তিক; পরিবেশ পরিস্থিতির বিবেচনায় কারও পছন্দ বদলে যেতেই পারে। সময়ের সাথে সাথে কর্তৃত্ব যেমন স্থানান্তরিত হয়, ভালোবাসার ব্যাপারটাও ঠিক তেমন।
ফ্রিদিওফের বাড়িতে খবর চাউর হতে সময় লাগল না। এ-ব্যাপারে কথা বলার জন্য মা ওকে একদিন ডেকে পাঠালেন। বেশ নাটকীয়ভাবে শুরু করলেন তিনি, “ফ্রিদি, আমার মনে হয় তোমার এখন জীবনসঙ্গী খোঁজার মত বয়স হয়েছে মায়ের গলা থমথমে শোনাল।
“এসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, মা! আমি একজনকে পছন্দ করে রেখেছি” ফ্রিদিওফ যেন ঝলমল করে উঠল।
মা এবারে আরও গম্ভীর। মনে হল, যেন খাদের কিনারা থেকে কথা বলছেন তিনি,
–আমার মনে হয়, তুমি একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে ফেলছ। যে মেয়েটাকে তুমি পছন্দ করেছ বলে সন্দেহ হচ্ছে, তার নৈতিকতা-বোধ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কোন শিক্ষিত মানুষের নৈতিকতা কিছুতেই এমন হতে পারে না।
–কী বলছেন আপনি? অ্যামির নৈতিকতা নিয়ে সংশয়! কে বলেছে আপনাকে এসব?
–এসব কথা শুধু মেয়েটার জন্য বলছি না, বলছি ওর বাবার জন্যও। তুমি বোধহয় জানো না, ওর বাবা একজন নাস্তিক।