ঐদিনের পর থেকে বোনদের সাথে নার্সারিতে ঘুমানো বন্ধ হল। মা। নিজের রুমে ফ্রিদিওফের খাট স্থানান্তর করলেন। কিন্তু ওর কাছে মায়ের। রুমটাকে ভীষণ বদ্ধ মনে হল। তাছাড়া, রাত-বিরাতে মা ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করতেন, ও সেরে উঠেছে কি না। ফ্রিদিওফের এতে বিরক্তির সীমা ছিল না। রাগে গজগজ করতে করতে মায়ের প্রশ্নের জবাব দিত।
*** *** ***
কেউ ঠিকঠাক মত সাজিয়ে-গুছিয়ে না-দেয়া পর্যন্ত বাইরে বেরোনো বারণ ছিল ফ্রিদিওফের। অনেকগুলো মাফলার ছিল ওর। নিজেও জানতো না কখন কোনটা পরতে হবে। কখনও মাফলার না পরে চুপিচুপি বাসা থেকে বেরোতে চেষ্টা করলেই কেউ-না-কেউ জানালা দিয়ে ঠিক দেখে ফেলত। তখন আবার ঘরে এসে মাফলার, ওভারকোট পরে তার পর বের হতে হত।
দিনে দিনে বোনদের খেলাগুলি বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। ওর পেশীবহুল হাত বাচ্চাদের খেলনা র্যাকেট কিংবা শাটলককে আর আনন্দ পেত না। বরং, পাথর ছুঁড়ে খেলা করাকে বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস মনে হত। ঘাসের মাঠে কাঠের বল ছুঁড়ে মারার খেলা নিয়ে প্যানপেনে ঝগড়াও ভীষণ বিশ্রী লাগত–“ধুর! এগুলোয় না লাগে কোন শক্তি, না কোন বুদ্ধি।” ওদিকে, এতসব যন্ত্রণার মাঝে আরেক মহাবিরক্তির কারণ ছিল–ওদের গভর্নের্স। এই মহিলা সব সময় ফ্রেঞ্চ ভাষায় নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করত। ফ্রিদিওফ নির্বিকারে সুইডিশে সেসবের জবাব দিত। এভাবে, দিনে দিনে চারপাশের সবকিছু মিলে কেমন একটা গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হতে লাগলো।
ফ্রিদিওফের উপস্থিতিতে সবাই যেভাবে খোলামেলা আলোচনা করত সেগুলো ওর মোটেই পছন্দ হত না। ফলে, মাঝে মাঝেই বাড়ির সবার সঙ্গে। খারাপ ব্যবহার করত। একমাত্র মা-ই ওকে কিছুটা বুঝতে পারতেন। তাই মাঝেমাঝে খানিকটা সময় নিজের মত করে কাটানোর সুযোগ করে দিতেন, ফ্রিদিওফের খাটের চারপাশে তিনি বড় করে পর্দা টানিয়ে দিলেন। এতে লাভ যেটা হলো তা হচ্ছে, বাড়ির সবার সাথে দেখা করাই বন্ধ করে দিল ফ্রিদিওফ। ওদেরকে দেখলেই কেমন গা জ্বালা করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, শুধুমাত্র রান্নাঘর আর কাজের লোকদের বিশ্রামের। জায়গাগুলোই ফ্রিদিওফের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলো। এই জায়গাগুলোতে ওর সবরকম আচরণ সহজেই গ্রহণযোগ্য ছিল। মাঝে মাঝে অবশ্য এমন সব। বিষয় নিয়ে আলোচনা হত যেগুলো যেকোন ছেলের মধ্যেই কৌতূহল জাগাবে; তবে ফ্রিদিওফের জন্য সেসব বিষয়েও কোন রাখঢাক ছিল না। অতএব, সে যখন যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পারতো, তা-ই করতে পারতো। একবার তো ভুল করে কাজের মেয়েদের গোসলের জায়গাতেই চলে গেল! এ-দৃশ্য দেখে ওদের গভর্নের্স চিৎকার করে উঠলো। ফ্রিদিওফ অবশ্য কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি, তাই গভর্নেসের চিৎকারে কোন আমলই দিল না। বরং, আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা পানিতে ভেসে বেড়ানো মেয়েদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে থাকলো। ওদের নগ্নতা ফ্রিদিওফের মধ্যে কোনও ভাবান্তর সৃষ্টি করল না।
এভাবেই ফ্রিদিওফ একসময় তারুণ্যে প্রবেশ করল। ওকে ফার্মের যাবতীয় কাজ শিখিয়ে-পড়িয়ে দেবার জন্য একজন ইন্সপেক্টর নিয়োগ করা হল। কারণ স্পষ্ট: কিছুদিন পর ওকেই তো সব দায়িত্ব নিতে হবে। প্রচলিত। রীতিনীতিতে বিশ্বাস করে এমন একজন বয়স্ক লোককে নিয়োগ দেয়া হল। ভদ্রলোকের সনাতন চিন্তা-ভাবনা কোন যুবককে আলোড়িত করার মত নাহলেও সেগুলো ফ্রিদিওফের মধ্যে বেশ পরিবর্তন আনলো, ওর চিন্তা জগতে কতগুলো নতুন দিক যোগ করলো, আর সর্বোপরি, ওকে কাজেকর্মে বেশ আগ্রহী করে তুললো। কিন্তু জট বাধলো অন্য জায়গায় বাড়ির ভেতর থেকে ভদ্রলোকের জন্য এত বেশি ফরমায়েশ আসে যে, সেগুলো নিয়েই তার সারা দিন কেটে যায়।
*** *** ***
পনেরো বছর বয়সে ফ্রিদিওফকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হল। এ-উপলক্ষে সে একটা স্বর্ণের ঘড়ি উপহার পেল। নিজেকে হঠাৎ বেশ বড় মানুষ মনে হতে লাগলো। এখন সে চাইলেই যখন-তখন ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে যেতে পারে। অবশ্য কিছু বিষয়ে বরাবরের মতই নিষেধাজ্ঞা ছিল, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বন্দুক নিয়ে শিকারে যাওয়া, অথচ এটাই ছিল ফ্রিদিওফের সবচেয়ে বড় শখ। যাহোক, আনন্দের ব্যাপার হল, এখন আর খালার হাতে মার খাওয়ার ভয় নেই। খালাকে এতদিন সে ঘোরতর শত্রু বলেই মনে করে এসেছে। তবে, খালার মারের ভয় না-থাকলেও ভয় কিন্তু একটা ছিল ‘মায়ের চোখের জল’। মায়ের কাছে ও সেই শিশু হয়েই রইল। ফলে অন্য মানুষের কথামত নিজের পছন্দ ঠিক করার অভ্যাসটা আর কখনোই পরিবর্তন করতে পারলো না ফ্রিদিওফ।
মাঝে কিছু বছর গেল।
ফ্রিদিওফ এখন বিশ বছরের যুবক। একদিন ও রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাজকর্ম দেখছিল। একটা মেয়ে পিঁড়িতে বসে মাছ কুটছিল। সদ্যযৌবনা মেয়েটা দেখতে মন্দ নয়। এরই মধ্যে ওর সঙ্গে খানিকটা ভাবও হয়েছে। আজ ফ্রিদিওফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার সাথে মজা করছিল। এক পর্যায়ে খেলাচ্ছলে মেয়েটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল, কোনমতে বলল–“কী করছেন!”
“যা করছি ঠিকই করছি” আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ফ্রিদিওফ।
“কেউ দেখে ফেলতে পারে” ভীত শোনাল মেয়েটাকে।
–দেখলে দেখুক।
রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ফ্রিদিওফের মা হেঁটে যাচ্ছিলেন। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়তেই তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে হাঁটা দিলেন। এইবেলা ফ্রিদিওফ বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। কী করবে ভেবে না পেয়ে, চট করে নিজের রুমে সটকে পড়ল।