ও সবসময় বোনদের সাথে সাথেই থাকত। একসঙ্গে খেলা করত, এমনকি গোসলেও যেত। কেউই ওকে ভিন্ন লিঙ্গের কেউ বলে গণ্য করত না। তবে, এই একসঙ্গে থাকায়, কিংবা খেলা করায় সবসময়ই ওকে বোনদের কর্তৃত্ব মেনে চলতে হত, নিজের মতামত প্রকাশ করার কোন সুযোগ ছিল না। ফলে অচিরেই বোনেরা ওর শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হল। অবশ্য, শিক্ষক না বলে প্রভু বলাটাই শ্রেয়তর; কারণ, বোনেরা যেভাবে যা করতে বলত তার বাইরে যাবার কোনও উপায় ছিল না।
ছোটবেলায় ওকে দেখে বেশ শক্ত-পোক্ত একটা ছেলে বলেই মনে হত। কিন্তু এত রমণীর ভিড়ে ধীরে-ধীরে ও কেমন শান্ত, লাজুক প্রকৃতির হতে থাকলো। নিজের জগত্তাকে ঘরের ভেতরেই গুটিয়ে রাখতে শুরু করল। মুক্ত হবার একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টা অবশ্য একবার ও করেছিল আশেপাশের সমবয়েসী ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল। সমস্ত দিন জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেছিল, গাছে চড়েছিল, পাখির বাসা চুরি করেছিল, কাঠবিড়ালি তাড়িয়ে বেড়িয়েছিলো, আরও কত কি! ফ্রিদিওফকে দেখে তখন সদ্যমুক্ত কোন আসামির মত মনে হচ্ছিল–মুক্তির আনন্দ যার পরম আরাধ্য। সেদিন রাতে খাবার জন্য বাড়ি ফেরেনি ও। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কোথা থেকে গাদাগাদা বুনো জাম জোগাড় করে খেয়েছিল। তারপর লেকের পানিতে দলবেঁধে ঝাপাঝাপি। এটাই ছিল ফ্রিদিওফের জীবনের প্রথম সত্যিকার আনন্দের দিন।
ফ্রিদিওফ যখন বাড়ি ফিরল, তখন সমস্ত বাড়ি কেমন থমথম করছে। মা এতক্ষণ ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন; কিন্তু ফ্রিদিওফ ফেরার পর আর আনন্দ গোপন রাখতে পারলেন না–জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলেন। এতকিছুর মধ্যেও একজনের আচরণ সবার থেকে আলাদা দেখালো–ফ্রিদিওফের খালা অগাস্থা। মহিলা বয়সে ওর মায়ের চেয়ে বড় হলেও বিয়ে করেননি বলে এ সংসার মূলত তার কর্তৃত্বেই চলে। ফ্রিদিওফ দেরি করে বাড়ি ফেরায় অগাস্থা ভীষণ রেগে গেল। রীতিমত অগ্নিশর্মা যাকে বলে! তার মনে হল, এই মুহূর্তে ওকে শক্ত শাস্তি না-দেয়াটা একটা অপরাধের সমতূল্য হবে। ফ্রিদিওফ কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, এটা অপরাধ হয় কী করে! কিন্তু অগাস্থাকে বোঝায় কার সাধ্য, অবাধ্যতা তার কাছে পাপের শামিল। অবশ্য, ফ্রিদিওফেরও নিজের পক্ষে যুক্তি ছিল “আমাকেতো কখনো আশেপাশের ছেলেদের সঙ্গে খেলতে বারণ করা হয়নি।” অগাস্থা এসব কানে তুলতে নারাজ। তার স্পষ্ট ঘোষণা–“এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন কথা শুনতে চাই না।” অতএব, মায়ের ক্ষীণ আপত্তি উপেক্ষা করে, ফ্রিদিওফকে শাস্তি দেবার জন্য জোর করে অগাস্থার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ওর বয়স বড়জোর আট হলেও দেখতে বেশ বড়োসড়ো না দেখায়। অগাস্থার চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ফ্রিদিওফের কপালে । আজ খারাপ কিছু আছে। কিন্তু ঠিক কোন মুহূর্তে যে সেটা ঘটতে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ করেই ফ্রিদিওফের প্যান্ট টেনে খোলার জন্য অগাস্থা ওর কোমরের বেল্ট ধরে ঝাঁকুনি দিল। সাথে সাথে ফ্রিদিওফের সারা শরীর কেমন হিম হয়ে গেল। মনে হলো, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে, বুকের ভেতর কে যেন গুমগুম হাতুড়ি পেটাচ্ছে। কিন্তু কোন শব্দ করল না; শুধু ভীতু শালিকছানার মত খালার দিকে চেয়ে রইল। অগাস্থা কিন্তু এতে কোন ভ্রুকুটি করল না। থমথমে গলায় বলল–“চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি, কোনরকম বজ্জাতি করবি না।” এ-পর্যন্তও মেনে নিয়েছিল ফ্রিদিওফ, কিন্তু খালা যখন শার্টে হাত দিল তখন রাগে-লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেল। চট করে লাফ দিয়ে সরে যেতে চাইল। মনে হল, অগাস্থার গা বেয়ে যেন কোন ঘৃণ্য-নোংরা কিছু বেড়িয়ে আসছে। চট করে ফ্রিদিওফের কাছে নিজের লিঙ্গ-পরিচয় আবিষ্কৃত হল। লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করল ও, কিন্তু সফল হল না। অগাস্থা পাগলের মত হিংস্রতায় খপ করে ধরে ফেলল। তারপর, একটা চেয়ারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে থাকল। সেই মুহূর্তে ফ্রিদিওফের মনে হল, ও যেন কোন ব্যথা অনুভব করছে না; কিন্তু রাগে চিত্তার করতে থাকলো। ক্রমাগত কিল-ঘুষি চালিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাইল। কিন্তু হঠাৎ করে কী যেন হল–সমস্ত শরীর কেমন নিথর-নিস্তেজ হয়ে এল। অগাস্থা যখন ছেড়ে দিল, তখনও ঠিক অমনই নিথর পড়ে রইল ফ্রিদিওফ।
“উঠে দাঁড়া!” কর্কশ গলার আদেশ শোনা গেল। উঠে দাঁড়াল ফ্রিদিওফ। খালার দিকে নিস্পলক চেয়ে রইল। মহিলার মুখের এক দিক। কেমন ফ্যাকাশে, আর অন্যদিকটা লালচে দেখাচ্ছিল, চোখ দুটো জ্বলছিল, সমস্ত শরীর কেমন থরথর করে কাঁপছিল। এবার আগ্রহ নিয়ে অগাস্থার দিকে তাকালো ফ্রিদিওফ–যেমনভাবে আগ্রহ নিয়ে মানুষ কোন বুনো জন্তুর। দিকে তাকায়। হঠাৎ ওর ঠোঁটে এক ধরনের অবজ্ঞার হাসি খেলে গেল। মনে হল ঘৃণা আর অবজ্ঞার প্রকাশই এই পরিস্থিতিতে ওকে জয়ী করবে। ‘ডাইনি মাগী!’ পাড়ার ছেলেদের থেকে নতুন শেখা গালিটা ভীষণ ঘৃণাভরে অগাস্থার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে, জামা-কাপড় তুলে, দ্রুত পালিয়ে গেল। নীচতলায় বসে ওর মা কাঁদছিল। সেখানে গিয়ে খালার নামে অভিযোগ ঝেড়ে প্রাণ জুড়াতে চাইলে ফ্রিদিওফ; কিন্তু লাভ হলো না। বড় বোনের বিরুদ্ধে ছেলেকে সান্ত্বনা দেবার মত সাহস মায়ের ছিল না। অতএব, ফ্রিদিওফকে সরে পড়তে হল। এলোেমলো হাঁটাহাঁটি করতে করতে রান্নাঘরে চলে এল। এখানে অবশ্য সান্তনা পাওয়া গেল। বাড়ির কাজের লোকেরা ওকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শেষমেষ কতগুলো খুচরো টাকা হাতে গুঁজে দিল, এতে বেশ কাজ হল।