বছর না-ঘুরতেই নতুন স্ত্রী এক সন্তান জন্ম দিল। বাবার অবশ্য এখন আর বাচ্চাকাচ্চার কান্নাকাটি শোনার মত যথেষ্ট ধৈর্য নেই, রাতের বেলার বিশ্রামই বেশি কাক্ষিত। স্ত্রীর ওজর-আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি শোবার ঘর আলাদা করার জোর প্রচেষ্টা চালালেন। উপায় না-দেখে স্ত্রী তো কান্নাকাটি করে অস্থির। “উফ! মেয়েরা যে কী পরিমাণ বিরক্তিকর!” যন্ত্রণার এখানেই শেষ নয়। দেখা গেল নতুন স্ত্রী আজকাল প্রথম স্ত্রীকে হিংসা করতে শুরু করেছে। দোষটা অবশ্য স্বামীর অতি সরলভাবে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীকে প্রথম স্ত্রীর সমস্ত গল্প বলেছিলেন, প্রেমপত্রগুলো পড়তে দিয়েছিলেন এবং, সর্বোপরি, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় স্ত্রীর অস্বাভাবিক মিলের কথা বলেছিলেন। এত কিছুর জানার পর দ্বিতীয় স্ত্রীর মনে হয়েছে–স্বামী আসলে তাকে ভালোবাসে না; বরং ভালোবাসে তার মধ্যে প্রথম স্ত্রীর ছায়াকে। সে আরও আবিষ্কার করেছে তাকে যেসব আদরের নামে ডাকা হয় সেগুলোর সবই প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল। অর্থাৎ, স্বামী আসলে তাকে অবহেলা করে। এই অবহেলা সহ্য করা সম্ভব নয়। অতএব, সে স্বামীর ভালোবাসা (যেটা শুধুই তার নিজের জন্য) আদায় করতে উঠে-পড়ে লাগল। নানা শয়তানী পরিকল্পনাও করলো। কিন্তু সেগুলোর কোনটাই স্বামীর মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক ভিন্ন কিছু করতে পারল না। ওদিকে স্বামীর মনে দুই স্ত্রীর মধ্যে তুলনা করা শুরু হয়ে গেল। সবদিক বিবেচনায় প্রথম স্ত্রীকেই সেরা বলে মনে হল। সন্তানদের প্রতিও আবার ভালোবাসা জেগে উঠল। ওদের বাড়ি ছেড়ে যেতে দেওয়ায় নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হল, অনুশোচনা হল। আজকাল তিনি ঘুমের মধ্যে খারাপ স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে জেগে উঠেন। মনে হয়, প্রথম স্ত্রীর স্মৃতি যেন তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সর্বোপরি, নিজেকে আজকাল বিশ্বাসভঙ্গকারী মনে হয়।
ঘরে তিনি আর কোনও শান্তি খুঁজে পান না। সবসময় মনে হয়, যেন এমন একটা চুক্তি করেছেন যে-চুক্তির শর্তগুলো পূরণ না-করাটাই শ্রেয়। অতএব ঘরের বাইরে পা বাড়ালেন তিনি। আজকাল বেশির ভাগ সময় কাটে ক্লাবে-ক্লাবে। স্ত্রীর এ-নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। মাঝে মাঝেই দুজনের মধ্যে ভীষণ কলহ হয়। স্ত্রীর মতে, স্বামী তাকে ধোঁকা দিয়েছে। অমন বুড়ো ভামের ঘরে যুবতী বৌ থাকা ঠিক না। ঘরে যুবতী বৌ রেখে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ালে তার ফল কক্ষনো ভালো হয় না। এজন্য পরে তাঁকে পস্তাতে হবে।
কী! এতবড় কথা! ‘বুড়ো’! স্ত্রী তাকে বুড়ো বলল! সে-ও দেখিয়ে দেবে, সে আসলে বুড়িয়ে যায়নি।
অতএব, দুজনের আবার এক-রুমে থাকা শুরু হল। তবে এবার যেটা ঘটল সেটা আগের চেয়েও শতগুণে খারাপ! বাচ্চার কান্নাকাটি সহ্য হয় না
–স্ত্রীর সাথে রাগারাগি করেন –“বাচ্চারা থাকবে নার্সারিতে, ঘরের মধ্যে এত উৎপাত কিসের?”।
স্ত্রী-ও ঠোঁট উল্টে প্রতিবাদ করে, “কই, আগের বৌয়ের বাচ্চাদের বেলায় তো এমন মনে হয়নি!”
অতএব, স্বামীকে যাবতীয় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়…
*** *** ***
এ-পর্যন্ত দু’বার তিনি ফিনিক্স পাখির (রূপকথার পাখি। মৃত পাখির ছাই থেকে নতুন পাখির জন্ম হয়।) জাগরণে বিশ্বাস করেছেন। সে-জাগরণ তাঁর চৌদ্দ-বছরের কিশোরী বধূর জাগরণ। প্রথমবার, তাঁর মৃত কন্যার মধ্যে সেই জাগরণ দেখেছেন; পরেরবার দেখেছেন দ্বিতীয় স্ত্রীর মধ্যে। কিন্তু তাঁর স্মৃতি তাকে কখনোই সেই চৌদ্দ-বছরের কিশোরীটিকে ভুলতে দেয়নি। বুনো স্ট্রবেরিতে রং লাগার সময় পাদ্রির বাড়িতে সেই প্রথম দেখা, প্রথম চুম্বন, প্রথম প্রেমাবেগ সবই যেন স্মৃতিতে অমলিন হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেই প্রথম প্রেমকে কখনোই আপন করে পাননি তিনি। এখন জীবনসায়াহ্নে এসে অন্ধকার হাতড়ে বৃদ্ধা স্ত্রীকেই বারেবারে মনে পড়ে, যে তাঁকে আর তাঁর সন্তানদের ভীষণ ভালোবাসত, আদরযত্ন করত; যে কখনোই তাঁর সঙ্গে রাগারাগি করেনি, যে সবসময়ই খুব সাধারণভাবে থাকত, নীরবে বসে স্বামী-সন্তানদের জামাকাপড় সেলাই করে দিত।
এতদিনে নিজেকে জীবনযুদ্ধে পরাজিত বলে মনে হয়। সত্যিকারের ফিনিক্স পাখি তিনি আসলে কখনো চিনতেই পারেননি। হয়ত তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী ই ছিল সত্যিকারের ফিনিক্স পাখি! সেই চৌদ্দ-বছরের কিশোরীর ছাই থেকে জন্ম নিয়ে ধীরে-ধীরে সে পরিণত হয়েছে, ডিম দিয়েছে নতুন ছানা জন্ম দেবার জন্য। তারপর, সে-ডিমে তা দিতে বুকের পালক ছিঁড়ে বাসা বেঁধেছে, ডিমের যত্ন নিয়েছে, ছানাদের বাঁচিয়ে রাখতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে নিজে পুড়ে ছাই হয়েছে। আফসোস! জীবনভর এই ধাঁধার পেছনে ছুটলেন তিনি! কিন্তু ক্লান্ত-শ্রান্ত মাথাটি শেষবারের মত বালিশের ওপর রাখার আগে, এই ভেবে তিনি স্বস্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন শেষ পর্যন্ত ধাঁধাটির সমাধান তিনি করতে পেরেছেন।
বিবাহ অনিবার্য
খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর মা, দুই বোন, আর খালাদের কাছেই ও মানুষ হয়েছিল। পুরো পরিবারে ছেলে-মানুষ বলতে ও একাই। সুইডেনের এক মফস্বল শহরে ওদের বসবাস। শহরটার নাম সোয়েডারম্যানল্যান্ড। চারপাশে এমন কোন প্রতিবেশী ছিল না যার সঙ্গে বসে প্রাণ খুলে একটু আলাপ করা যায়। সুতরাং, বাড়ির মধ্যেই পুরো পৃথিবী। ওর বয়স যখন সাত, তখন ওদের পড়ানোর জন্য একজন গভর্নেস রাখা হল। কিছুদিন পর এক খালাতো বোনও এসে যোগ দিল, বোনটি এখন থেকে ওদের বাড়িতেই থাকবে।