হঠাৎ একদিন পুতুলনাচের প্রতি মেয়ের আর আগ্রহ দেখা গেল না। তার মুখের হাসি বন্ধ হল, বন্ধ হল মুখের কথাও। অস্থি-চর্মসার শরীরটা থেকে শেষ অনুভূতিটুকুও কেড়ে নিল নিকষ কালো মৃত্যু। দীর্ঘ যন্ত্রণার অবসান হল।
অতঃপর সন্তানদের নিয়ে মা বাড়ি ফিরে এলেন। তার অনুশোচনার সীমা রইলো না। কারণ সন্তানের মৃত্যুকালে তিনি কাছে থাকতে পারেননি। সমস্ত বাড়ি যেন শোকে-যন্ত্রণায়-হতাশায় বিদ্ধ হয়ে রইল। ডাক্তার এসে লাশের ময়নাতদন্ত করতে চাইলে বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি চান না তাঁর মেয়ের শরীর ছুরি-কাঁচি দিয়ে কাটাকুটি করা হোক। কারণ, তাঁর কাছে মেয়ে এখনও জীবন্ত। ডাক্তার সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। বাবা ভীষণ রেগে গেলেন: চিৎকার-চাচামেচি করে, ডাক্তারকে এলোপাথাড়ি লাথি দিয়ে, কামড়াতে উদ্যত হলেন।
মেয়েকে কবর দেয়ার পর বাবা সেই কবরের পাশে একটা স্মৃতি ফলক বানালেন। প্রতিদিন সেই ফলকের কাছে গিয়ে বসে থাকেন। এভাবে, পুরো একটা বছর পেরিয়ে গেল। দ্বিতীয় বছরে তাঁর যাতায়াত অনেকটাই কমে এল। কাজের চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে। অবসর সময়ও তেমন একটা পান না। তাছাড়া তিনি এখন বুঝতে পারেন–বয়স হয়েছে, চলাফেরায় আগেকার সেই স্বাচ্ছন্দ্য আর নেই। একটু-একটু করে মেয়ের জন্য দুঃখ কমতে থাকল। মাঝে মধ্যে যখন মনে হয়–আজকাল মেয়ের জন্য তেমন দুঃখ করা হয় না–তখন অবশ্য তিনি নিজের কাছে নিজেই ভীষণ লজ্জায় পরে যান। এমনি করে এক সময় তিনি মেয়ের কথা ভুলেই গেলেন।
এরপর তাদের আরও দুটো কন্যাসন্তান হল। কিন্তু কেউই আগের কন্যার মত হল না। একজন চলে গেলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় অন্য কেউ এসে তা কখনোই পূরণ করতে পারে না।
সংসার এখন একেবারেই রং-রূপহীন, বৈচিত্র্যহীন হয়ে গেছে। স্ত্রীর বয়স হয়েছে। আগেকার সেই সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। স্বামীর আচরণেও বয়সের ছাপ স্পষ্ট। এক সময়ের সোনায়-মোড়ানো সংসার এখন সাদামাটা। ছেলেমেয়েগুলো বেশ চঞ্চল হয়েছে। বাড়িঘরজুড়ে তাদের দুরন্তপনার চিহ্ন ছড়ানো-ছিটানো। বাবা-মায়ের বিয়ের উপহার তো অনেক আগেই ভেঙ্গেচুরে একাকার করেছে, ঘরের আসবাবপত্রও তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি–খাটের তোষক ছেঁড়া, টেবিলের পায়া ভাঙ্গা, সোফার কভারের ফুটো দিয়ে শতচ্ছিন্ন ফোম উঁকি দিচ্ছে, আরও যে কত কি! পিয়ানোটা অনেকদিন মধুর সুরে বাজে না। পরিবর্তে বাচ্চাদের কর্কশ চাচামেচিতে বাড়িঘর ঢেকে থাকে। ‘আদর’, ‘ভালোবাসা’ শব্দগুলো অনেক আগেই পুরনো হয়ে গেছে। ওগুলোকে যেন ময়লা মোছার ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। প্রেমস্পর্শ’ বলতেও কিছু আর নেই এখন। স্পর্শ এখন শুধু প্রয়োজন ফুরানোর প্রচেষ্টা মাত্র। বাবাকে আর মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসতে দেখা যায় না। তিনি বসে থাকেন একটা জীর্ণশীর্ণ আর্মচেয়ারে। চুরুট জ্বালানোর দরকার হলে মাকে ডাকেন। এর বাইরে দুজনের তেমন কথাবার্তা হয় না। স্পষ্ট বুড়িয়ে যাচ্ছেন। জীবনের রং ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
*** *** ***
বাবার বয়স যখন পঞ্চাশের কাছাকাছি, হঠাৎ করেই তখন মা মারা গেলেন। বাবাকে যেন এবার অতীত এসে জাপটে ধরল। মায়ের হালকা-পাতলা-রুগ্ন। শরীরটা কবরে নামানোর সময় তাঁর চোখে ভেসে উঠল চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীর ছবি। অনেকদিন আগে হারানো কিশোরীটির শোকে পাগলপারা হলেন তিনি। সে শোক আজ আফসোস হয়ে ঝরে পড়ছে। বাবা অবশ্য কখনোই মাকে কোন অযত্ন বা অবহেলা করেননি। সেই চৌদ্দ বছরের। কিশোরী, পাদ্রির কন্যাটির প্রতি তিনি সব সময়ই বিশ্বস্ত ছিলেন। সেই কিশোরীকে পূজা করতেন তিনি, হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করতেন। কিন্তু সে প্রার্থনার মন্দিরে প্রবেশ করার সুযোগ পাননি তিনি; কারণ তিনি বিয়ে করেছিলেন চব্বিশ বছর বয়সী এক মলিনকেশী নারীকে। অকপট স্বীকারে মানতেই হত, তিনি ঐ চৌদ্দ বছরের কিশোরীটির জন্যই শোক করছিলেন। তবে একথাও সত্য, বৃদ্ধা স্ত্রীর চমৎকার রান্না আর সীমাহীন যত্নআত্তির প্রচন্ডরকম অভাব বোধ করছিলেন তিনি। যদিও দুটো অনুভূতির মধ্যে বিস্তর ফারাক।
এতদিনে সন্তানদের সঙ্গে বাবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হল। সবাই অবশ্য এখন আর বাড়িতে থাকে না। লেখাপড়া, চাকরীর জন্য কেউ কেউ অন্যত্র থাকে। যারা বাড়িতে থাকে তাদের সঙ্গেই বাবা সারাদিন গল্পগুজব করেন। তবে তিনি সন্তানদের সঙ্গ উপভোগ করলেও সন্তানরা তাঁর সঙ্গ কতটা উপভোগ করে সেটা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ সন্তানদের নিয়ে বসলে তিনি একই গল্প বারবার বলেন, স্ত্রীর নানা মজার কাহিনি শোনান। বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই দেখা গেল, গল্পগুলো কেমন একঘেয়ে হয়ে গেছে। বাবা। অবশ্য সমান আগ্রহ নিয়েই বলে যান…
*** *** ***
একদিন এক কাকতালীয় ঘটলা ঘটল–বাবার সঙ্গে এক অষ্টাদশী স্বর্ণকেশীর দেখা হল। দেখতে ঠিক সেই কিশোরী প্রিয়ার মত। বাবার কাছে। এ কাকতালীয়তাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে হল। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, ঈশ্বর তাঁর ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন। মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি, বিয়েও করলেন। এতদিনে তিনি যেন সেই কিশোরী প্রিয়াকে আপন করে পেলেন। কিন্তু বিপত্তি বাধলো সন্তানদের। নিয়ে। বিশেষত, তাঁর মেয়েরা এ ঘটনায় ভীষণ ক্ষেপে গেল। তাদের পক্ষে কিছুতেই এটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। বাবা তাদের মায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলেই ধরে নিল তারা। সুতরাং বাবার সঙ্গে আর থাকা সম্ভব নয়। সন্তানরা যার যার মত নিজের পথ বেছে নিল। তবে বাবা কিন্তু নিজের কাজে যথেষ্ট সন্তুষ্ট। নতুন স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর যতটা না সুখ, তার চেয়ে বেশি গর্ব। বন্ধুদের কাছে স্ত্রীর গল্প করে তিনি বাহ্বা পাওয়ার চেষ্টা করেন। বন্ধুরা অবশ্য ভালোমন্দ কোন মন্তব্য করে না। দু’একজন শুধু বলেছে–“কয়েকটা দিন যেতে দাও, তখন দেখা যাক কী হয়।”