“অসম্ভব!” ব্যারনের বউয়ের বজ্রনিনাদ। “কোনও রকম জারিজুরি চলবে না।”
এবার, অ্যানাকে রোগে ধরল। ক্রমাগত সে শুকাতে থাকল, সেই তালে ব্যারনের ছেলের ক্রমাগত কান্না। দৃশ্যপটে আবারও ডাক্তার।
–ওকে কিছুদিন স্বামীর সাথে থাকতে দিন।
–কিন্তু বাচ্চার সমস্যা হবে যে!
–না-না, অল্প কয়েকদিনে তেমন কিছু হবে না।
কিন্তু অ্যানডার্সটাকে আগে তলিয়ে দেখতে হবে। কোন বদ মতলব আছে কি না জানা দরকার! অ্যানডার্স গড়িমসি করতে থাকল… এবং…, ‘তলিয়ে দেখা সম্পন্ন হল। প্রক্রিয়াটি অবশ্য খুব জটিল কিছু না–কতগুলো ভেড়া পেয়েই অ্যানডার্স সন্তুষ্ট। তার গড়িমসি বন্ধ হল। বন্ধ হল ব্যারনপুত্রের কান্নাও।
কিছুদিন পর, এতিমখানা থেকে এক দুঃসংবাদ এলো–অ্যানার ছেলেটা ডিপথেরিয়ায় মারা গেছে।
অ্যানা যেন কেমন হয়ে গেল। সব সময় মনমরা হয়ে থাকে, কাজেকর্মে সাড়া পাওয়া যায় না, সব কিছুর প্রতি কেমন একটা উদাস-উদাস ভাব। ফলাফল যা হবার তাই হল–আবারও ব্যারনপুত্রের ক্রন্দনরোল। এবার আর কোন মধ্যবর্তী পন্থা চিন্তা করা হল না, অ্যানাকে চাকরি হারাতে হল। ওকে অ্যানডার্সের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নতুন নার্স নিয়োগ দেয়া হল।
শেষ পর্যন্ত, বউ ফিরে পেয়ে অ্যানডার্সততা আহ্লাদে আটখানা। অবশ্য, এ আহ্লাদ আর্তনাদে পরিণত হতেও খুব বেশি সময় নিল না–অ্যানা বড় খরুচে হয়ে গেছে। ব্রাজিলিয়ান কফি না-হলে তার মুখে রুচে না, প্রতিদিন একই খাবার পছন্দ হয় না। সপ্তাহে ছয়দিন মাছ খেতে-খেতে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে, ফার্মে কাজ করতে ভীষণ কষ্ট হয়। ফলে, ফার্মের উৎপাদন কমে গেল। লোকসান সামলাতে না-পেরে, বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই অ্যানডার্সকে ফার্ম ছাড়তে হল। এইবেলা ব্যারন বেশ দয়া দেখালেন ওদেরকে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতে দিলেন।
*** *** ***
অ্যানা এখন ব্যারনের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। হামেশাই ব্যারনপুত্রের সঙ্গে তার দেখা হয়। অ্যানাকে সে চিনতে পারে না। অবশ্য চিনতে চায় না বলাটাই যথার্থ হবে। এমনই তো হবার কথা ছিল–ব্যারনপুত্রকে নিজের বুকের দুধ খাইয়েছে সে, তাকে বাঁচাতে গিয়ে পেটের ছেলেকে বলি দিয়েছে; আজ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ (!) ব্যারনপুত্র তাকে চিনবে না সেটাই তো স্বাভাবিক, সেটাই তো আভিজাত্য। যাহোক, অ্যানা কিন্তু যথেষ্ট উৎপাদনশীল ছিল। পরবর্তীতে তার আরও অনেকগুলো ছেলেপুলে হয়েছে, যারা ক্ষেতে-খামারে মজুর হিসেবে, কিংবা কুলি হিসেবে রেলওয়েতে কাজ করে। একজন আবার দাগী আসামি, এখন জেল খাটছে।
ব্যারন সাহেব এখন পুত্রের বিয়ের দিন গুনছেন। নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে আকুল তিনি। পুত্র অবশ্য খুব একটা শক্তপোক্ত হয়নি। যে-কারণে ব্যারন সাহেব মাঝে মাঝেই অন্যরকম ভাবেন–সেই এতিমখানায় মারা যাওয়া পুত্রটি যদি আজ তাঁর উত্তরাধিকারী হত, তবে তিনি অনেকটাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন। ইত্যবসরে, দ্বিতীয়বারের মত ‘দ্য স্লেভস অব লাইফ’ পড়ে ব্যারন সাহেব স্বীকার করতে বাধ্য হলেন–“উঁচু শ্রেণি টিকেই থাকে নীচু শ্রেণির দয়ার ওপর।” ডারউইনের পুনঃপঠনে তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না–“প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপারটা সবসময়ই অলঙ্ঘনীয়। যে যা-ই বলুক না কেন এ সত্য চিরদিন ধ্রুব হয়েই থাকবে।”
এ ডলস্ হাউস
বিয়ের বয়স প্রায় ছ’বছর হয়েছে। কিন্তু এখনও দেখলে প্রেমিক-প্রেমিকাই মনে হয়। স্বামী জাহাজের ক্যাপ্টেন। প্রত্যেক গ্রীষ্মে দীর্ঘভ্রমণে বের হতে হয়। ফলে বেশ কিছুদিন বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। এতে অবশ্য এক রকম ভালোই হয়েছিল। কারণ, শীতকালে নিজেদের মধ্যে একটু-আধটু মন কষাকষি হলেও কিছু দিনের অনুপস্থিতি শেষে দুজনের প্রেম একেবারে নতুন করে শুরু হত!
স্বামী জাহাজে থাকাকালীন নিয়মিত স্ত্রীকে চিঠি লেখে, আর পাশ দিয়ে কোন জাহাজ যেতে দেখামাত্র চিৎকার করে বলে–“আমার চিঠিটা নিয়ে যাও, প্লিজ।” এমনি করে কতভাবে, কত চিঠি যে সে পাঠায় তার ইয়াত্তা নেই। অবশেষে একদিন যখন দূর থেকে স্টকহোমের বন্দর দেখা যায়, তখন ক্যাপ্টেনের আর তর সয় না। কীভাবে, কত দ্রুত স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে। শেষমেশ একটা বুদ্ধি মাথায় খেলে যায়–স্ত্রীকে টেলিগ্রাম করে দেয়, যেন সে আগে থেকেই বন্দরের কাছে দালাছড়া শহরের কোন একটা হোটেলে এসে ওঠে।
জাহাজ বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছালে হোটেলের বারান্দায় একটা ছোট্ট নীল স্কার্ফ উড়তে দেখা যায়। সেটা দেখেই স্ত্রীর উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয় স্বামী। “আহ! জগতে এর চেয়ে আনন্দ বুঝি আর হয় না!” কিন্তু সময় যে যেতে চায় না! বন্দরে ভেড়ার পরও জাহাজে এত কাজ থাকে যে মুক্তি পেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। জাহাজ থেকে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে করে আসার সময়ও সে বার-বার মুখ বের করে অতি কষ্টে স্ত্রীর মুখটা দেখার চেষ্টা। করে। এবং … এবং, অবশেষে তাদের সাক্ষাৎ! তারা যে কী বলবে, কী করবে, তার যেন কোন কূল-কিনারা পায় না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে স্বামী ভাবে, “ও ঠিক আগের মতই আছে। সেই হাসি, সেই সৌন্দর্য, সেই উফুল্লতা, সবই সেই আগের মত: ঠিক যেমন আগেরবার দেখেছিলাম।” স্ত্রীর মনেও একই ভাবনা। এভাবেই কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে কাটে তাদের। এরপর আস্তে আস্তে অস্থিরতা খানিক কমে, সবকিছু একটু স্বাভাবিক হয়। এবার খোঁজ-খবর নেয়ার পালা: সমুদ্র, ঘর, বাচ্চাকাচ্চা, ভবিষ্যৎ, কোনটা ছেড়ে যে কোনটার কথা বলবে সে আরেক মধুর সমস্যা! ওদিকে যে রাতের খাবারের সময় বয়ে যাচ্ছে সেদিকে কারও কোন হুশ নেই! হঠাৎ করেই স্বামী যেন সবকিছু ভুলে আলতো করে স্ত্রীর হাতটা ধরে। তার চুম্বনে সেই প্রথম স্পর্শের মত লজ্জায় লাল হয়ে যায় স্ত্রী! কাঁচের গেলাসে মদের ফোয়ারা ছোটে।