দুজনের বাগদান হয়ে গেল। সারাদিন ওরা পাখিদের মত কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। জীবন যেন সবুজ ঘাসে মোড়ানো এক উদ্যান, যার একটি ঘাসও এখনও মাড়ানো হয়নি। হেসেখেলে দিন যায়। কিন্তু ছেলেটির লেখাপড়া এখনও শেষ হয়নি; বিশেষত খনিজ বিষয়ক পরীক্ষায় এখনও পাশ করা হয়নি। পরীক্ষায় পাশ করা, উচ্চতর গবেষণায় দেশের বাইরে যাওয়া ইত্যাদিসহ সবকিছু মিলিয়ে আরও প্রায় দশ বছর লাগবে। দ…শ বছর। অতএব, বিয়েটা দশ বছর পরেই হবে। এরকম পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেল।
গ্রীষ্মের ছুটিতে ছেলেটি আবারও সেই পাদ্রির বাড়িতে ছুটে গেল, প্রিয়তমার সাথে দেখা করল। প্রিয়তমা ঠিক আগের মতই আছে–কানায় কানায় পূর্ণ অটুট সৌন্দর্য। দেখে প্রাণটা ভরে গেল। কয়েকদিন পর ছুটি শেষ করে ছেলেটি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেল। এভাবে পর পর তিনটি গ্রীষ্মে প্রিয়তমাকে একইভাবে পেল। কিন্তু চতুর্থবার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা গেল–প্রিয়তমার নাকের গোড়ায় ছোট ছোট লাল দাগ, কাঁধটাও যেন খানিকটা ঝুলে পড়েছে।
ষষ্ঠ গ্রীষ্মে, প্রিয়তমার ভীষণ দাঁত ব্যথা; সেই সঙ্গে স্নায়ুবিক দুর্বলতা। এগুলো তাকে ভীষণ কাবু করে ফেলল। চুলের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেল, কণ্ঠস্বর কেমন কর্কশ হয়ে গেল, নাকের চারপাশ কালো-কালো দাগে ভরে উঠলো, চোয়াল বসে গেল। সর্বোপরি, চরম স্বাস্থ্যহানি ঘটল। সে বছর শীতে কাঁপুনি জ্বরও হল। ডাক্তারের পরামর্শে চুল কেটে ফেলতে হল। চুলগুলো যখন আবার বড় হল, দেখা গেল সেগুলো আর আগের মত উজ্জ্বল নেই, কেমন মলিন হয়ে গেছে।
ছেলেটি প্রেমে পড়েছিল এক স্বর্ণকেশীর। সে স্বর্ণকেশীর মলিন কেশ এখন আর আকর্ষণ করে না তাকে। তাই বলে সে কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতাও করল না। চব্বিশ বছর বয়স্কা সেই মলিনকেশীকেই সে বিয়ে করল, যার উচ্ছ্বাস এখন অনেকটা ভাটার দিকে, যে এখন একটু বড় গলার জামা পড়তে অস্বস্তি বোধ করে। এসব মেনে নিয়েও ছেলেটি মেয়েটিকে ভালোবাসে। ভালাবাসার আবেগ অনেকটা কমে গেছে এই যা। বরং, সেখানে দায়িত্ব ভর করেছে। এই দায়িত্বপূর্ণ ভালোবাসা নিয়েই ওরা বেশ সুখে দিন কাটায়। খনির ছোট শহরটার কোন কিছুই ওদের সুখে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না।
সংসারে একে-একে দুটো পুত্র সন্তানের আগমন ঘটলো। স্বামী অবশ্য মনে-মনে কন্যার আশা করছিল। একদিন সে আশাও পূর্ণ হলো। চকচকে চুলের এক কন্যা সন্তান এলো তাদের সংসারে। মেয়ে যেন বাবার চোখের মণি। যত দিন যায় সে দেখতে তত তার মায়ের মত হয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে ওর বয়স যখন আট হল, দেখলে মনে হয় যেন ওর মায়ের আট বছর বয়সের কোন ছবি। এই ছোট্ট মেয়েটির জন্য বাবা তার সমস্ত অবসর সময়গুলো উৎসর্গ করেন।
কন্যার মা সারাদিনই ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকেন। ঘর-গৃহস্থালির কাজ করতে-করতে তাঁর হাতে, কপালের কাছে, ভাঁজ পড়ে গেছে। রান্নাঘরে ক্রমাগত উবু হয়ে বসে কাজ করায় কাঁধও ঝুলে পড়েছে। এভাবেই, সংসারে তিনি একেবারে থিতু হয়ে গেছেন। স্বামীর সঙ্গে মন খুলে দুটো কথাও বলা হয় না। দুজনের দেখা হয় কেবল খাবার টেবিলে, আর রাতের বেলা। অবশ্য, এসব নিয়ে তাদের কোন অভিযোগও নেই–সত্যিটা তো এমনই, জীবনের গতি বদলায়।
*** *** ***
বাবার জীবনের একমাত্র সুখ তাঁর কন্যা। মনে হয়, বাবা যেন মেয়ের প্রেমে পড়েছেন! মেয়ের মধ্যে তিনি মেয়ের মায়ের ছায়া খুঁজে পান। মেয়ের মাকে প্রথম দেখে যে অনুভূতি হয়েছিল, মেয়েকে দেখেও তড়িৎ সে অনুভূতি খেলে যায়। যে-কারণে মেয়ের উপস্থিতিতে বাবা বেশ সচেতন আচরণ করেন। মেয়ের পোষাক-আশাক পরিবর্তনের সময় কখনো তার রুমে যান না। সর্বোপরি, মেয়েকে যেন পরম শ্রদ্ধায় পূজা করেন তিনি।
এক সকালে মেয়ে হঠাৎ বিছানায় পড়ল। উঠে দাঁড়ানোর কোন লক্ষণ নেই। মা ভাবলেন মেয়েকে আলসেমিতে পেয়েছে। তাই তেমন গা করলেন না। বাবা কিন্তু দুঃশ্চিন্তায় পড়লেন। তড়িঘড়ি করে ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তার যা বললেন তাতে সমস্ত বাড়ি মৃত্যুপুরীর মত নীরব হয়ে গেল। “ডিপথেরিয়া”। এমতাবস্থায়, অন্য বাচ্চাগুলো এখানে থাকলে ওদেরও সংক্রমিত হবার আশঙ্কা আছে। অতএব, অন্য সন্তানদের নিয়ে বাবা কিংবা মায়ের যেকোন একজনকে কিছুদিন দূরে কোথাও থাকতে হবে। বাবা মেয়েকে ছেড়ে থাকতে রাজি নন। সুতরাং, সন্তানদের নিয়ে মা শহরের অন্য প্রান্তে একটা ছোট ঘর ভাড়া করলেন, আর বাবা রইলেন মেয়ের সেবাযত্ন করতে। মেয়ে কিন্তু বিছানাতেই পড়ে রইল।
ঘরজুড়ে সালফারের গন্ধে টেকা দায়। বাঁধানো ছবিগুলো সালফারের তীব্রতায় কালচে হয়ে গেল, ড্রেসিং টেবিলের পেছনের রূপার প্রলেপও জায়গায়-জায়গায় ক্ষয় হল। আর নীরবে ক্ষয় হতে থাকলো মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন। কান্না বুকে চেপে রেখে শূন্য ঘরে পায়চারি করেন বাবা। রাতে একা বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করেন। নিজেকে বিপত্নীক বলে মনে হয় তাঁর। কিন্তু মেয়েকে এসবের কিছুই বুঝতে দেন না। মেয়ের জন্য নানা খেলনা কিনে আনেন, পুতুলনাচ দেখান, আরও কত কি! এসব দেখে মেয়ে তাঁকে শুষ্ক হাসি উপহার দেয়। সেই হাসিতেই বাবার ক্ষণিক-আনন্দ। মাঝে মাঝে সামান্য সময় বের করে মেয়ের মা-ভাইদের দেখতে যান। কিন্তু পাছে ওরা আবার সংক্রমিত হয়, এই ভয়ে কাছে যান না, দূর থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, সন্তানদের চুম্বন ছুঁড়ে দেন। তাঁর স্ত্রী লাল নীল কাগজে লিখে লিখে দূর থেকেই নানা খোঁজখবর জানান।