হ্যাঁ, ভীষণ।
স্ত্রীর বাধা সত্ত্বেও ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার এসে জানালো “দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই, এমনিতেই হয়ত একটু খারাপ লেগেছে, আবার এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।” অতএব, স্বামীর বাড়িতে বসে থাকার কোন মানে হয় না। সে নির্দ্বিধায় ব্যবহারিক ক্লাস নিতে চলে গেল। ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরতে ভোর হয়ে গেল। অথচ, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ক্লান্তির ছাপ নেই। উপরন্তু, তাকে বেশ টগবগে দেখাচ্ছে। অনেক দিন পর খুব চমৎকার একটা দিন পার করেছে সে, অ…নে…ক দিন পর।
“উঁহুহুহু…” এতক্ষণ চেপে রাখা আবেগ এবার কান্না হয়ে স্ত্রীর চোখেমুখে ঝড় তুলল। এত দূর সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়–স্বামীকে এখন প্রতিজ্ঞা করতেই হবে যে, তাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে সে কখনো ভালোবাসবে না, কক্ষনো না।
তুমুল কান্নাকাটির এক পর্যায়ে, স্ত্রী হঠাৎ মৃগী রোগীর মত ছটফট করতে লাগল। স্বামী দৌড়ে গেল স্মেলিং সল্ট আনতে। খানিক পর স্ত্রী একটু স্বাভাবিক হলে, একটু-একটু করে তাকে নানা কথা বলতে লাগল। মেয়েদের সাথে রাতের খাবারের খুঁটিনাটি বিবরণ না-দিলেও, অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে কথা হল তাদের মধ্যে। স্ত্রী যখন অতগুলো পুরুষ মানুষের মাঝে রাত্রিবেলায় মিটিংয়ে গিয়েছিল স্বামীর তখন কেমন লেগেছিল সে কথাও বলল। স্ত্রী এখন কান্না করছে কেন? কোন বিষয়টা তাকে কাঁদাচ্ছে? সে নিশ্চয়ই ঈর্ষা করছে না? নাকি করছে? অধিকারবোধটা যদি দুদিক থেকেই কাজ না-করে তাহলে সেটা সত্যিকারের ভালোবাসাই নয়। স্বামীর ওপর অধিকারবোধ কাজ করেছে বলেই নিশ্চয়ই তাকে হারানোর ভয়ে স্ত্রী এখন কাঁদছে? কারণ, হারানোর ভয়টা অধিকারবোধ থেকেই আসে। স্বামীরও কিছুদিন আগে ঠিক এই কারণেই অমন খারাপ লেগেছিল।
এভাবেই, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার বেশ কিছুদিনের জমে থাকা ভুল বোঝাবুঝি আপাত ঠিকঠাক হল। তবে, চিড় ধরানোর জন্য মালামালের বিভাগ আর মেয়েদের স্কুল কিন্তু কাঁচি নিয়ে তৈরি হয়েই ছিল!
*** *** ***
কিছুদিন পর একটা বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর প্রশান্তিতে আবারও ছন্দপতন হল–
স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার ধারণা, সেদিন অফিসে লেবারদের কাজে যেচে সাহায্য করতে গিয়েই এই বিপত্তি ঘটেছে। লেবাররা সেদিন কতগুলো ভারী বাক্স ওঠাচ্ছিল। তার নিজের সামনেও পড়ে ছিল একটা। লেবারদের অপেক্ষা না-করে, অতি উৎসাহী হয়ে সে একাই উঠাতে গিয়েছিল ওটা। ফলস্বরূপ, আজ বিছানায়।
কিন্তু ঘটনা কি আসলেই তাই?
উঁহু ঘটনা অন্য জায়গায়!
সে ঘটনা জানতে পেরে স্ত্রী ভীষণ রেগে গেল, আর পুরো দোষটা চাপালো স্বামীর ঘাড়ে। বাচ্চাটাকে নিয়ে এখন কী করবে তারা? “ওকে তো বোর্ডিংয়ে মানুষ করতে হবে!”
হ্যাঁ, রুশো (স্বামী) একাই এজন্য দায়ী! রুশোটা আসলে আস্ত বোকা, না-হলে এমন কাজ কেউ করে? যাহোক, স্বামী হিসেবে সমস্ত দোষ মাথা পেতে নিতে সে মোটেও আপত্তি করল না; বরং ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরবর্তীতে আর কখনো মেয়েদের ক্লাস না-নেয়ার প্রতিজ্ঞা করল। তবে, এতকিছুর পরও স্ত্রীর বিরক্তিভাব কমেনি। সে এখন আর গুদাম ঘরে যেতে পারবে না ভাবতেই গা জ্বলছিল। এখন থেকে বাধ্য হয়ে তাকে অফিসের সামনের রুমে বসে মালামালের হিসাব লিখে রাখার কাজ করতে হবে। কিন্তু এসব কিছুর বাইরেও সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার যেটা ঘটল সেটা হল, এক সহকারীর আবির্ভাব, যার গোপন অভিসন্ধি ছিল যেকোনভাবে অফিসে স্ত্রীর চেয়ারটা দখল করা।
অফিসে সহকর্মীদের আচরণ আজকাল কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। এমনকি লেবাররাও তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে। স্ত্রী ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মনে হয়, কোথায় যে লুকাবে তাই যেন ভেবে পায় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এখানে বসে মানুষের দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হওয়ার চেয়ে বরং ঘরে বসে স্বামীর জন্য রান্নাবান্না করাও ভালো। “উফ! মানুষগুলোর মনে কত রকম আজেবাজে চিন্তা যে থাকে! আর ভালো লাগে না।”
গত একমাস যাবত স্ত্রী বাড়িতে রয়েছে। অফিসে যাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব ঠেকছে। সে এখন প্রায় সবসময়ই ক্ষুধার্ত থাকে। সকাল হতে-না হতেই তার জন্য স্যান্ডউইচ আনাতে হয়। শরীরটা সারাক্ষণ কেমন যেন ঝিমঝিম করে। মনে হয়, যেন যেকোন সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। ফলে, বেশিরভাগ সময়ই বিশ্রাম নিতে হয়। কী একটা জীবন! কষ্টই বোধ হয় মেয়েমানুষের ভাগ্যের লিখন।
*** *** ***
অবশেষে সেই দিনটি এল। তাদের সন্তান আলোর মুখ দেখলো।
বাচ্চার বাবার জিজ্ঞাসা–“এখন কি আমরা ওকে বোর্ডিংয়ে রেখে আসবো?”
“ছিঃ, পুরুষ মানুষের কি হৃদয় বলে কিছু নেই?”
সন্দেহ নেই, বাচ্চার বাবার হৃদয়জাতীয় কিছু একটা আছে! অতএব, বাচ্চা বাড়িতেই বড় হতে লাগলো।
এর পর, একদিন অফিস থেকে এল এক অমায়িক চিঠি: বাচ্চা এবং বাচ্চার মা ভালো আছে তো?
হ্যাঁ, তারা দুজনেই ভালো আছে, এবং আগামী পরশুদিন বাচ্চার মা আবার অফিসে ফিরবে।
তবে, সত্যিকারে বাচ্চার মা এখনো কিছুটা দুর্বল রয়ে গেছে; যে কারণে তাকে গাড়ি ভাড়া করে অফিসে যেতে হয়। অবশ্য, খুব শীঘ্রই সে শরীরে বল ফিরে পেতে শুরু করল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়: বাচ্চাটার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখতে হয়। অবশ্য, শীঘ্রই সুবিধাজনক একটা বুদ্ধিও বের হল–বাচ্চার খোঁজ-খবর জানাতে একটা ছেলেকে নিয়োগ দেয়া হল। প্রথমদিকে ছেলেটাকে বাড়িতে পাঠানো হত দিনে দু’বার; কিছুদিন পর থেকে, প্রতি দু’ঘণ্টা পর-পর। বাচ্চার মা যখনই শুনে বাচ্চা কাঁদছে, তৎক্ষণাৎ সবকিছু ফেলে বাড়ি ছুটে যায়। ওদিকে, অফিসে তার পদটি দখলের চিন্তায় একজন তো আছেই। তবে তার বিভাগীয় প্রধান বেশ সদয় ব্যক্তি, এই যা বাঁচোয়া।