একদিন(অবশ্য রাত বলাটাই ভাললা) স্ত্রী স্বামীকে জানালো, পরের শনিবার রেলওয়ে বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক মিটিং আছে। মিটিং শেষে রাতের খাবারের আয়োজনও থাকবে। সেখানে তাকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। খবরটা শুনে স্বামীর কেমন একটু খচখচানি লাগলো। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি যাবে?”
“অবশ্যই যাবো” স্ত্রী বেশ জোর দিয়ে বলল।
স্বামী আগের মতই অস্বস্তি নিয়ে রইলো–“কিন্তু এতগুলো পুরুষ মানুষের মধ্যে তুমিই একমাত্র মহিলা। তাছাড়া, জানোতো পুরুষ মানুষের পেটে মদ পড়লে অন্য কিছু আর খেয়াল থাকে না।”
–তুমি তোমার বন বিভাগের মিটিংয়ে আমাকে ছাড়া যাও না?
“অবশ্যই যাই কিন্তু সেখানে আমি একগাদা মহিলার মাঝে একমাত্র পুরুষ হিসেবে থাকি না।” যুতসই জবাব দিতে পারায় স্বামীকে খুশি দেখালো।
স্ত্রী এই ভেবে অবাক হল, তার স্বামী, যে কিনা সবসময় নারীমুক্তির কথা বলে, আজ এমন কথা বলছে! তার মিটিংয়ে যাওয়া নিয়ে আপত্তি করছে! সে কি ভুলে গেছে, নারী আর পুরুষ সমান-সমান?
শেষ পর্যন্ত স্বামীকে হার মানতে হল। স্বীকার করতেই হল, এগুলো তার ব্যক্তিগত বিভ্রান্তি। এতক্ষণ সে যা বলেছে তার সবই ভুল এবং সর্বোপরি, স্ত্রীর মতামতই সঠিক। কিন্তু সবকিছু মেনে নিয়েও সে স্ত্রীকে বারবার অনুনয় করল না-যাবার জন্য। আসলে ব্যাপারগুলো সে ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছে না, আবার মন থেকে মানতেও পারছে না।
“তুমি অযৌক্তিক আচরণ করছ” স্ত্রী বিরক্ত হল।
স্বামী মেনে নিল, তার আচরণগুলো ঠিক যৌক্তিক হচ্ছে না। তবে, এটাও সত্য যে, নতুন এ যৌক্তিকতার সাথে মানিয়ে নিতে কম করে হলেও আরও অন্তত দশটি প্রজন্ম পর্যন্ত সময় লাগবে!
ঠিক আছে, তাহলে স্বামীরও এখন থেকে আর মিটিংয়ে যাওয়া চলবে না।
তা কী করে হয়? দুটো ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ স্বামীর মিটিংগুলোতে শুধুমাত্র পুরুষ মানুষেরাই থাকে। তাছাড়া স্বামীতে স্ত্রীকে মিটিংয়ে যেতে নিষেধ করেনি; যে ব্যাপারটা তার পছন্দ হচ্ছে না তা হল, রাতের বেলায় একা-একা এতগুলো পুরুষ মানুষের সাথে মিটিং করতে যাওয়া।
স্ত্রী মোটেই একা-একা যাচ্ছে না। অফিসের ক্যাশিয়ারের স্ত্রীও যাবে।
কিন্তু কী হিসেবে যাবে?
কেন, ক্যাশিয়ারের স্ত্রী হিসেবে!
তাহলে, স্বামী হিসেবে সে-ও কি যেতে পারে না?
তা হয়তো পারে, কিন্তু এসবের মধ্যে গিয়ে নিজেকে সে একেবারে সস্তা বানিয়ে ফেলবে না?
নিজেকে সস্তা বানাতে স্বামীর কোন আপত্তি নেই।
আচ্ছা, স্বামী কি হিংসা করছে?
অবশ্যই, কেন নয়? তাদের দুজনের মধ্যে অন্য কিছু আসতে পারে এই ভেবে সে রীতিমত আতঙ্কিত হচ্ছে।
ঊহ্! কী লজ্জা! কী অপমান, অবিশ্বাস! কী ঈর্ষা! স্বামী তাকে কী মনে করে?
মনে করে, তার স্ত্রী সম্পূর্ণ নিখুঁত। মনে করে, সে এতক্ষণ যা বলেছে তা ঠিক নয়। স্ত্রী ইচ্ছা করলে মিটিংয়ে যেতে পারে।
বাহ্! কী অবলীলায় স্বামীর আত্মবনমন!
স্ত্রী মিটিংয়ে গেল। শেষ করে বাড়ি ফিরতে ভোর হয়ে গেল। ফিরেই স্বামীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে জানালো, সবকিছু খুব ভালোভাবে শেষ হয়েছে। স্বামী মৃদু হাসলো। উৎসাহ পেয়ে স্ত্রী আরও নানান খুঁটিনাটি বলতে লাগলো–কেউ একজন তার প্রশংসা করে বক্তৃতা দিয়েছে, তারা সবাই একসঙ্গে গানে গলা মিলিয়েছে এবং শেষ পর্যায়ে, তাদের সমবেত নৃত্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটেছে।
কিন্তু এই ভোরবেলা স্ত্রী বাড়ি ফিরল কীভাবে?
কেন? ওই বেআক্কেলটা পৌঁছে দিয়ে গেছে।
কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলত!
তাহলেই বা কী হত? নিঃসন্দেহে সবাই তাকে একজন সম্মানিত নারী হিসেবেই চেনে, তাই না?
হ্যাঁ, তা ঠিক আছে; কিন্তু কেউ যদি সত্যিই দেখে ফেলত তাহলে কিন্তু সম্মানহানি ঘটত।
আসলে এসব কিছুই না, সত্যি কথাটা হল–স্বামীর ঈর্ষা হচ্ছে, তাই না? আর তার চেয়েও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, স্বামী তাকে হিংসা করছে। সে আসলে স্ত্রীর প্রতিটি ছোটখাটো আনন্দকেই হিংসা করে।
এই তাহলে বিয়ের আসল অর্থ? স্ত্রী বাড়ির বাইরে গেলে, সামান্যতম মজা করলেও তাকে কথা শুনতে হবে? উহ! বিয়ে আসলে কী? বিয়ে আসলে নিতান্ত অর্থহীন, নির্বোধ একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু তাদের মিলনকে কি সত্যিকার অর্থে বিয়ে বলা যায়? তাদের ঘনিষ্টতা হয় শুধুমাত্র রাতের বেলা; যেমনটি আর দশটা সাধারণ দম্পতিরও হয়। তাহলে, কিসের ভিত্তিতে তারা নিজেদেরকে অন্যরকম মনে করে? তার স্বামীতে দেখা যাচ্ছে আর দশটা সাধারণ স্বামীর মতই চিন্তা করে।
কী আর করা যাবে? সব পুরুষই একরকম! বিয়ের আগে পর্যন্ত তারা সভ্য থাকে, কিন্তু বিয়ের পর… উহ্! বিয়ের পর…! তার স্বামীও অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। স্ত্রীকে সে নিজের সম্পত্তি মনে করে, মনে করে, সে চাইলেই যখন-তখন স্ত্রীকে আদেশ করতে পারে! স্বামী আর আগের মত নেই
হয়ত তাই! একটা সময় ছিল যখন স্বামী মনে করত, তারা একে অন্যের; কিন্তু চিন্তাটায় আসলে মস্ত ভুল ছিল। সে হয়ত তার স্ত্রীর, কিন্তু তেমনই যেমন থাকে একটা কুকুর তার মনিবের! সে তার স্ত্রীর ভৃত্য বৈ অন্য কিছুতো নয়, যাকে রাখা হয় কেবল রাতের বেলা বাড়ি পাহারা দেবার জন্য। সে হয়ত ‘স্ত্রীর স্বামী, কিন্তু স্ত্রী কি কখনো স্বামীর স্ত্রী হবার চেষ্টা করেছে? তারা দুজন কি আসলেই সমান-সমান?