হোটেলে সারাদিনে স্ত্রীর করার মত তেমন কোন কাজ নেই। সময় কাটে বিলিয়ার্ড খেলে, আর পিয়ানো বাজিয়ে। রাতের অর্ধেকটা কাটে নারী অধিকার নিয়ে নানা বিপ্লবী আলোচনা করে, আর হুইস্কি খেয়ে।
স্বামীর বেতন পাঁচ হাজার ডলার। এর পুরোটাই তিনি স্ত্রীর হাতে তুলে দেন, এবং তৎক্ষণাৎ সেটা স্ত্রীর সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এর বাইরেও পোশাক আশাকের খরচা বাবদ তাকে আরও পাঁচশ ডলার দেয়া হয়, যেটা দিয়ে সে যা খুশি তাই করতে পারে।
কিছুদিন পর তাদের সন্তান হল। সন্তানের দেখাশোনার জন্য একশো ডলার দিয়ে একজন নার্স রাখা হল। এই নার্সই মায়ের মত করে বাচ্চাটির যত্নআত্তি করে। সময়ের সাথে সাথে তাদের আরও দুটি সন্তান হল। সন্তানেরা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে ব্ল্যাকউডপত্নীর কোন মাথাব্যথা নেই। তার বরং দিন-দিন আরও বেশি একঘেয়ে লাগে।
একদিন সকালে কিঞ্চিৎ মাতাল অবস্থায় স্ত্রীকে নাস্তার টেবিলে দেখা গেল। স্বামী মোটামুটি দুঃসাহসিক পর্যায়ের(!) একটা কাজ করলেন, স্ত্রীকে বলে বসলেন–“তোমাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।” এ-কথা শুনে স্ত্রীরতো রীতিমত মৃগীরোগীর মত অবস্থা! খাবার টেবিল ছেড়ে তিনি খাটে গিয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে হোটেলের অন্যান্য রুমের মহিলারা ফুল নিয়ে তাকে দেখতে এলেন। অত্যাচারী স্বামীর প্রতি নানা বিষোদ্গার করলেন। এরা চলে গেলে ধীরে-সুস্থে এলেন স্বামী। যথাসম্ভব মমতাভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এত মদ্যপান কেন কর, বলতো? কোন কারণে কী তুমি নিজেকে অসুখী মনে কর?”
“আমি কীভাবে নিজেকে সুখী মনে করি, বলো? আমার পুরো জীবনটাই যে অপচয় হল!” কান্নাভেজানো কণ্ঠে জবাব দিলেন স্ত্রী।
“এসব তুমি কী বলছ?” স্বামী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। “অপচয় বলতে তুমি কী বোঝ? তোমার তিন-তিনটা ছেলেমেয়ে আছে। চাইলেই ওদের দেখাশোনা করে, শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে তুমি সময় পার করতে পার।”
–নিজের ছেলেমেয়েদের কোন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো আমার পছন্দ না।
–তাহলে তুমি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করতে পার। সেক্ষেত্রে, তোমার জীবনের একটা মহান লক্ষ্য থাকবে, তোমার জন্য অন্যেরা উপকৃত হবে, আর সর্বোপরি পুরো সমাজ তোমাকে সম্মান দেবে। অন্তত, জাহাজ-জেটির কর্মচারীর চেয়ে বেশি সম্মানতো বটেই!
–হুম, সবই ঠিক আছে। কিন্তু ইস! আমি যদি স্বাধীন হতাম!
স্বামী এবারে মরিয়া হয়ে উঠলেন, “তুমি অবশ্যই স্বাধীন; অন্তত আমার চেয়ে বেশি স্বাধীন। ভেবে দেখ, সবসময় তুমিই সিদ্ধান্ত নাও আমার উপার্জন কীভাবে, কোনপথে খরচ হবে। আমি বরং তোমার কর্তৃত্বে থাকি। নিজের ইচ্ছামত খরচের জন্য তুমি মাসে পাঁচশ ডলার হাতখরচ পাও; অথচ আমাকে দেখ, আমার কিন্তু কোন হাত-খরচ নেই। আমার কোন খরচাপাতি লাগলে, এমনকি সিগারেট কেনার টাকাও তোমার থেকে চেয়ে নিতে হয়। এত কিছুর পরও তোমার মনে হয় না, তুমি আমার চেয়ে স্বাধীন?”
স্ত্রী কোন জবাব দিলেন না। মনে হল, শেষের প্রশ্নটা তিনি শুনতেই পাননি! তবে এ আলোচনার ফলাফল বেশ ব্যাপক হল। সিদ্ধান্ত হল, হোটেল ছেড়ে এবার তারা বাসাবাড়িতে উঠবে। বাড়ির পরিবেশে হয়ত মন চনমনে থাকবে। তাছাড়া বাড়ির খরচাপাতির খুঁটিনাটি হিসাব রাখার ব্যাপারেও মনস্থির করা হল–এতে অন্তত করার মত কিছু কাজ পাওয়া যাবে।
*** *** ***
কিছুদিন পরের ঘটনা। ব্ল্যাকউডপত্নী তার এক বান্ধবীকে চিঠি লিখলেন
বন্ধু,
আমি অসুস্থ। ক্লান্ত-শ্রান্ত আমি যেন দিন-দিন মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি। জানি, এমন কষ্টের মধ্য দিয়েই আমাকে যেতে হবে। কারণ যে নারীর জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই, তার জন্য জগতে কোন সান্ত্বনা নেই, তার মত দুঃখীও কেউ নেই। কিন্তু আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। জগৎকে দেখিয়ে দেব, স্বামীর টাকায় খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মত মেয়ে আমি নই। আর একারণেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি কাজ করতে শুরু করব; মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে যাবো আমি….
অতঃপর, ব্ল্যাকউডপত্নীর কর্মময় জীবন শুরু হল। প্রথমদিন তিনি সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠলেন। স্বামীর রুমটা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করলেন। কাজের লোককে সরিয়ে দিয়ে নিজেই রান্নাবান্না করতে শুরু করে দিলেন। দুপুর একটার সময় ব্ল্যাকউড সাহেব যখন লাঞ্চ করতে বাড়ি এলেন, খাবারদাবার তখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। দোষটা অবশ্য কাজের লোকেরই হল! যাহোক, স্ত্রীর কালিঝুলিমাখা ক্লান্ত চেহারা দেখে স্বামী বেচারা খাবার নিয়ে কোন অভিযোগ করলেন না। চুপচাপ একখানা আধপোড়া কাটলেট খেয়ে আবার কাজে বের হয়ে গেলেন। যাবার সময় স্ত্রীকে বলে গেলেন “এত খাটাখাটনি করো না, সোনা! শরীর খারাপ করবে।”
সন্ধ্যাবেলায় ব্ল্যাকউডপত্নী এত বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন যে বাকি কাজ শেষ করা আর সম্ভব হল না। দশটার দিকে তিনি ঘুমুতে গেলেন।
পরদিন সকালবেলা ব্ল্যাকউড সাহেব স্ত্রীর রুমে গেলেন। বেশ অবাক হলেন তিনি স্ত্রীকে আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু উজ্জ্বল দেখাচ্ছে যেন! ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জিজ্ঞেসই করে বসলেন, “রাতে নিশ্চয়ই ভালো ঘুম হয়েছে?”
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?” স্ত্রীকে সন্দিগ্ধ দেখালো।
“কারণ, আজ তোমাকে অন্যদিনের চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে” হাসতে হাসতে বললেন স্বামী।