হতোদ্যম ব্যারনের যেন জাত গেল! প্রমাণিত হলো, তাঁর স্ত্রী নিজের গর্ভের ফসলকে টিকিয়ে রাখতে অক্ষম। অতএব, হয় তাকে অন্য স্ত্রীলোকের থেকে দুধ কিনতে হবে, নয়তো চুরি-ডাকাতি করে আনতে হবে! ব্যারনের বংশ চুরির সম্পত্তিতে টিকে থাকবে? এ-ও ছিল ঘটে!
–কিন্তু পয়সা দিয়ে দুধ কিনলে তাকে কি চুরি-ডাকাতি বলা যায়?
–অবশ্যই বলা যায়। কারণ, যে টাকা দিয়ে এটা কেনা হল, সেটা তো। কারও না কারো পরিশ্রমের ফসল। কার পরিশ্রম? অবশ্যই সাধারণ জনগণের পরিশ্রম; কেননা, অভিজাত সম্প্রদায় তো আর যা-ই করুক পরিশ্রম করে না।
হুমম! ডাক্তার ব্যাটা তাহলে সমাজতান্ত্রিক!
অবশ্য, ডারউইনের অনুসারীও হতে পারে–কথার মধ্যে কেমন একটা অন্যরকম গন্ধ আছে! তবে, যে যা-ই বলুক না কেন, ডাক্তার সাহেব নিজে এগুলোর কোনটাতেই গা করেন না। এসব তাত্ত্বিকতা নিয়ে মাথা ঘামানোর মত যথেষ্ট অবসর তাঁর নেই।
কিন্তু “পয়সা দিয়ে কেনা মানে ডাকাতি করা “ এ বড় শক্ত কথা। এক্ষেত্রে বিধান কী বলে? “যদি ঐ টাকা দিয়ে কেনা হয়, যে টাকা পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়নি!” সংশয়ী ব্যারনের প্যাচালো জিজ্ঞাসা।
“অর্থাৎ, কায়িক পরিশ্রমের কথা বলছেন তো?” ডাক্তার সাহেবের সরলীকরণ।
“ঠিক তাই।” আনন্দে হাতে কিল দিলেন ব্যারন।
কিন্তু এভাবে চিন্তা করলে তো দেখা যায় ডাক্তারও ডাকাতি করে!
হুমম! ঘটনাতো তা-ই দাঁড়াচ্ছে।
তবে, যা-ই হোক না কেন, সত্য স্বীকারে ব্যারন পিছপা হবেন না, এমনই তাঁর প্রতিজ্ঞা। কিন্তু গুরুগম্ভীর আলোচনার এ পর্যায়ে খানিক বিঘ্ন ঘটলো। সঠিক সিদ্ধান্ত চেয়ে ব্যারন সাহেব এক খ্যাতনামা প্রফেসরের কাছে। লোক পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলে পাঠিয়েছেন, “স্পষ্টত ব্যারন একজন খুনী; কারণ, তাঁর উচিত ছিল আরও আগেই নার্স নিয়োগ করা।”
তবে আর কী!
এবার তাহলে বউকে রাজি করানোর পালা। ব্যারনকে তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে হল। পূর্ববর্তী সকল যুক্তি ত্যাগ করে একটাই অবস্থান তৈরি হল–‘সন্তানের প্রতি ভালোবাসা’ (যদিও এখানে উত্তরাধিকার আইনের প্রভাব কতটা, তা বলা যাচ্ছে না!)।
কিন্তু মূল সমস্যা তো মূলেই রইল! নার্স পাওয়া যাবে কোথায়? শহরে খোঁজা উচিত হবে না, কারণ শহুরে মানুষের নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু নেই। নাহ্! গ্রাম থেকেই আনতে হবে। তবে, একটা ব্যাপারে বউয়ের ঘোরতর আপত্তি আছে, “অবিবাহিতা কোন নার্স হলে চলবে না।” অবিবাহিতা মেয়ে অথচ তার বাচ্চা আছে, এমন মেয়েতো দুশ্চরিত্রা। আর, এমন কারও বুকের দুধ পান করলে তাঁর ছেলের স্বভাবেও খারাপ কিছু ঢুকে যেতে পারে!
অতএব, এ-ব্যাপারেও ডাক্তারকে হস্তক্ষেপ করতে হলো–“যেসব নার্স অন্যের বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়, তারা সবাই-ই অবিবাহিতা; কারণ, একজন সামর্থ্যবান স্বামী কখনোই তার স্ত্রীকে অন্যের বাড়ি গিয়ে, অন্যের সন্তানকে স্তন্যপান করাতে দেবে না। বরং চাইবে, স্ত্রী-সন্তান তার নিজের কাছেই থাকুক।
ব্যারনের কপালে চিন্তার ভাজ, এবং অতঃপর… ইয়েস! আইডিয়া পাওয়া গেছে। তারা যদি কোন গরীব ঘরের মেয়েকে নিজেদের পরিচিত কোন মজুরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়?
তবুও তো অন্তত নয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।
তাহলে ধরা যাক, বাচ্চা আছে এমন কোন মেয়েকে তারা বিয়ে দিয়ে দিল?
হুম! সেটা অবশ্য মন্দ নয়!
তিন মাসের একটা বাচ্চা আছে এমন এক মেয়েকে ব্যারন চিনতেন। বেশ গভীরভাবেই চিনতেন বলা যায়; কারণ, তিন বছর সম্পর্কের পর ‘ডাক্তারের নির্দেশে তিনি মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অগত্যা, সেই মেয়েটির কাছেই প্রস্তাব নিয়ে গেলেন–অ্যানডার্স নামের এক মজুরকে যদি সে বিয়ে করতে রাজি হয়, তবে তাকে আস্ত একটা ফার্ম দিয়ে দেয়া হবে। মেয়েটা চিন্তা করে দেখল–একা একা লাঞ্ছনা সহ্য করার চেয়ে এমন লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হওয়াটাই বুদ্ধিমতির কাজ হবে। সুতরাং, পরের রোববার বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হল। এবার, বউকে রেখে পরবর্তী দুমাসের জন্য অ্যানডার্সকে তার গ্রামের বাড়ি চলে যেতে হবে।
একটা বিষয় নিয়ে ব্যারন সাহেব মনে মনে হিংসায় জ্বলে মরছিলেন ‘নার্সের বাচ্চা ছেলেটা। বড়-সড়, শক্ত-পোক্ত একটা বাচ্চা। যদিও দেখতে ভালো নয়, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায় এ জিনিস অনেকদিন টিকবে! বেঁচে থাকার জন্যই এর জন্ম হয়েছে, স্বপ্নপূরণের জন্য নয়। তবে, ব্যারনের ছেলে আর নার্সের ছেলে তো এক বাড়িতে, এক মায়ের দুধ খেতে পারে না, তাই না? তাই, কায়দা করে নার্সের ছেলেটিকে এতিমখানায় পাঠিয়ে দেয়া হল। প্রথমদিকে অ্যানা (নার্স) ভীষণ কান্নাকাটি করল। কিন্তু এ বাড়ির এলাহী খানাদানা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার কান্না থামাতে সমর্থ হল (তার খাবার আসত ঘরের ভেতর ডাইনিং রুম থেকে; আর, মদ তো যখন যেমন খুশি চলতই)। বাড়ির বাইরে যাবার ব্যাপারেও তার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। মস্ত ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, গার্ড সাথে নিয়ে সে বেড়াতে বের হত। অবসরে আরব্য রজনীর গল্প পড়ত। জীবনে এত সুখ কখনও সে কল্পনাও করেনি।
দুমাস পর আবার অ্যানডার্সের দেখা মিলল। এ অব্দি সে ফার্মেই ছিল। এতদিন খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কিছুই করেনি। এবার আবদার করল অ্যানাকে কাছে পাবার জন্য। “মানে, অ্যানাকে কি অন্তত মাঝে মাঝে দু’ একদিনের জন্যও পাঠানো যায় না?”