এ রকম নানা সাত-পাঁচ ভেবে, স্বামী একদিন এক বিবাহিত বন্ধুর সাথে এসব নিয়ে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। হাজার হলেও তারা একই গোত্রভুক্ত!
–বিয়ে করেছ কতদিন হল?
–ছ’ বছর।
–আচ্ছা! এই দীর্ঘ সময়ে বৈবাহিক বিষয়ে কখনো বিরক্ত হওনি?
–হতাম, প্রথম দিকে হতাম। ছেলেপুলে হবার পর সেসব কেটে গেছে।
–তাই নাকি? তাহলে তো ছেলেপুলে না-থাকায় আমরা বেশ দুর্ভাগা মানতে হবে।
–উঁহু! এ তোমাদের দোষ নয় দোস্ত! বউকে বলো ডাক্তার দেখাতে।
বন্ধুর সঙ্গে আলাপ শেষে বাড়ি ফিরে বহুদিন পর স্ত্রীর সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলল স্বামী। স্ত্রীকে সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর সে ডাক্তার দেখাতে রাজি হল।
দু’সপ্তাহ পর বাড়িতে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা গেল।
পুরো বাড়িতে যেন কী এক চঞ্চলতা ভর করেছে। ড্রইংরুমের টেবিলের ওপরে, এখানে-ওখানে, বাচ্চাদের পোশাক আলুথালু হয়ে পড়ে থাকে। হঠাৎ করে কেউ ঘরে ঢুকলে সেগুলো গোছানোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পরে যখন দেখা যায়, মানুষটা অন্য কেউ নয়, তার স্বামী, তখনই সেগুলো আবারও যথাস্থানে ফিরে আসে! শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। বাচ্চার জন্য নাম ঠিক করতে হবে। ওরা মোটামুটি নিশ্চিত, ছেলে সন্তানই হবে। সুতরাং, ছেলেদের নামের তালিকা তৈরি করা হল। অবশ্য, আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এর মধ্যে করতে হবে–স্ত্রীকে নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে হবে, মেডিকেল বই বানাতে হবে, বাচ্চার খেলনা-দোলনা কিনতে হবে, আরও কত কি…
*** *** ***
অবশেষে সন্তানের আগমন ঘটল। সত্যিই একটা ছেলে হল। স্বামী যখন দেখল তার ছোট্ট বানরছানাটি(!) স্ত্রীর বুকের দুধ পান করছে তখন একরকম শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্ত্রীর মধ্যে মাতৃত্ব আবিষ্কার করল সে। যখন দেখল, স্ত্রীর বড় বড় চোখ দুটি পরম মমতায় সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছে তখন মনে হল, স্ত্রী যেন সন্তানের মুখে চেয়ে ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে। আর ঠিক তখনই সে নতুন করে অনুভব করল, আসলেই স্ত্রীর চোখে গভীরতা আছে। সে গভীরতা এতটাই বেশি যে স্বামীর সমস্ত ধর্মকাহিনি আর নাটক দিয়েও তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। স্বামীর সমস্ত পুরনোভালাবাসা, প্রিয় পুরনো ভালবাসা, নতুন স্ফুলিঙ্গের মধ্য দিয়ে জ্বলে উঠল যেন। নতুন সে স্কুলিঙ্গে নতুনতর একটা কিছু যোগ হয়েছে, যার খানিকটা সে অনুভব করেছে মাত্র, পুরোপুরি এখনও বুঝে উঠতে পারেনি!
“ইস! স্ত্রী যখন এটা-সেটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করে তখন ওকে কী চমৎকার দেখায়! আর, বাচ্চার যেকোন সমস্যা কী অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সাথেই না সমাধান করে!” সত্যি, তার স্ত্রী বুদ্ধিমতী বলতে হবে!
ওদিকে স্বামীর মধ্যেও কিছু পরিবর্তন দেখা গেছে। ইদানিং সে নিজেকে একজন দায়িত্ববান পুরুষ বলে ভাবে। ব্যারনের ঘোড়া আর কাউন্টসদের ক্রিকেট খেলার গল্প না-করে বরং সারাক্ষণ ছেলের গল্পই করে; সম্ভবত একটু বেশিই করে! মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময় যখন বাইরে যেতে হয়, সেই পুরো সময়টা মন পড়ে থাকে ঘরের মধ্যে। অবশ্য, এই কারণে নয় যে স্ত্রী বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে, বরং, এই ভেবে যে, স্ত্রী এখন আর একা বসে অপেক্ষা করে না! বাড়িতে ফিরে দেখে মা-ছেলে দুজনেই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চাটাকে মাঝে মাঝে একটু ঈর্ষাই হয়। নিজে বাইরে থাকার সময় কেউ একজন বাড়িতে একা বসে অধীরভাবে অপেক্ষা করছে এই চিন্তাটার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত আনন্দ আছে, যে আনন্দটা থেকে সে এখন বঞ্চিত। তার কারণতো ওই বাচ্চাটাই।
যা হোক, স্বামী এখন চাইলে বিকেলে ঘুমাতে পারে। কারণ, তার ঘুমানো বা না-ঘুমানোতে কারো কিছু যায় আসে না। সে অফিসের কাজে বাইরে যাওয়ামাত্র পিয়ানো বের করে আনা হয়। সেই পুরনো ‘বুনো গোলাপ’ গানটা বাজানো হয়। সে গানে আবার নতুনত্ব এসেছে; কারণ, ছোট্ট হারল্ডতো এ গান আগে শোনেনি। তাছাড়া, অনেক দিন বাদে শোনার কারণে হারল্ডের মায়ের কাছেও গানটা এখন নতুন বলে মনে হয়।
স্ত্রীর এখন উল দিয়ে জামাকাপড় বোনার মত যথেষ্ট সময় নেই। ঘরে। এখন এমনিতেই রেডিমেড কেনা অসংখ্য ছোট-ছোট জামাকাপড় রয়েছে। ওদিকে, স্বামীও তার গবেষণাপ্রবন্ধে অতটা সময় দেয় না–“থাক, ওটা না হয় হারল্ড বড় হয়ে করবে।” প্রায় সন্ধ্যাতেই স্বামী-স্ত্রীকে পাশাপাশি বসে গল্প করতে দেখা যায়। তবে, এটাকে এখন আর গল্প না বলে আলোচনা। বলাটাই ভালো। কারণ, স্ত্রীও এখন কথা বলায় অংশগ্রহণ করে। সে জানে, কোন্ বিষয় নিয়ে কীভাবে কথা বলতে হবে। আর, এটাও স্বীকার করে, আগে সে নিতান্ত বোকাসোকা একটা মেয়ে ছিল–ধর্মকাহিনি কিংবা নাটক সম্পর্কে কোন জ্ঞান না-থাকায় চুপচাপ বসে থাকত। স্বামীকে বহুবার বলারও চেষ্টা করেছে, কিন্তু স্বামী সে কথায় কান দেয়নি। স্বামী অবশ্য এখনও কান দেয় না!
স্বামী-স্ত্রী এখন একসাথে তাদের প্রিয় গানটা গায়। ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে ছোট্ট হারল্ডও তাতে অংশ নেয়। সে হাসি যেন নতুন ছন্দ যোগায়। ছন্দের তালে ওরা গা এলিয়ে দেয়, সেই তালেই দোলা দেয় দোলনাতে। পুরনো গানটা যেন ভীষণ জীবন্ত হয়ে উড়ে বেড়ায় ঘরময়…
দেনা-পাওনা
মিস্টার ব্ল্যাকউড ব্রুকলিনের কাছে একটা জাহাজ-জেটিতে কাজ করেন। সম্প্রতি মিস ড্যাঙ্কওয়ার্ড নামের এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করে মোটা অঙ্কের যৌতুক পেয়েছেন। স্ত্রীর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তিনি চিন্তা করে দেখলেন, বাসা-বাড়িতে থাকলে কাজ করতে গিয়ে স্ত্রী হয়তো মন ছোট করে থাকতে পারেন; কিংবা, নিজেকে হয়তো পরাধীন বলে ভাবতে পারেন! তাই ঝামেলা এড়াতে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি একটা হোটেলে উঠলেন। এখন থেকে এখানেই থাকা হবে!