পরদিন স্ত্রী আর স্বামীর অফিসে দেখা করতে গেল না। স্বামী কিন্তু দুপুরে খেতে এসে এ নিয়ে একটা কথাও বলল না। তবে, অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি কথা বলল। কথা বলার সময় স্ত্রীর দিকে খুব একটা মনোযোগ ছিল না তার, বরং কিছুক্ষণ পর মনে হল যেন সে একা-একাই কথা বলছে। সন্ধ্যার সময় ‘যসতালম’ প্রসাদের জীবন যাপনের লম্বা বর্ণনা দিয়ে স্ত্রীকে আনন্দ দেবার চেষ্টা করল স্বামী। তরুণীরা ব্যারনের সঙ্গে কীভাবে কথা বলে তা অভিনয় করে দেখালো, কাউন্টস এর ঘোড়াগুলোর নাম একে-একে বলে গেলো। কিন্তু এসবের কিছুতেই স্ত্রীকে বিশেষ উৎসাহিত মনে হলো না।
পরের দিন সন্ধ্যায় স্ত্রীকে নিজের গবেষণা প্রবন্ধের ব্যাপারে বলল স্বামী। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সন্ধ্যায় তাদের গল্পের সময়টা খুব গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে কথা বলার সময়ে পরিণত হয়ে গেল।
*** *** ***
একদিন বিকেলে স্বামী ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। স্ত্রী এতক্ষণ ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছিল, আর উল দিয়ে কাপড় বুনছিল। হঠাৎ, উলের বলটা হাত থেকে পড়ে গেল। স্বামী সে সময় সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। উলের সুতা ছড়িয়ে তার পায়ে জড়িয়ে গেল। ভীষণ রেগে গিয়ে স্ত্রীর হাত থেকে উলে বোনা-কাপড় টেনে নিয়ে সবকিছুসমেত উলের বলটাকে লাথি দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। এমন নির্দয় ব্যবহারে স্ত্রী চিৎকার করে উঠল। স্বামীর রাগ যেন পড়ছেই না। গলা চড়িয়ে বলল, এসব জঞ্জাল নিয়ে মাথা ঘামানোর মত সময় তার নেই। স্ত্রীকে উপদেশ দিল লাভজনক কোন কাজ করতে। পেশাজীবনে উন্নতি করতে চাইলে নিজের গবেষণা-প্রবন্ধটা যেকোন মূল্যে এবার সম্পূর্ণ করতেই হবে। সেক্ষেত্রে, স্ত্রীর উচিত হবে এসব জঙ্গল নিয়ে বসে না-থেকে কীভাবে সংসারের খরচ কমানো যায় সে চিন্তা করা।
বোঝা যাচ্ছে, পানি বেশ দূর অব্দি গড়িয়েছে।
পরদিন জলভরা চোখে স্বামীর জন্য মোজা বানাচ্ছিল স্ত্রী। স্বামী বলে বসল, “ওগুলো আরও কমদামে রেডিমেড কিনতে পাওয়া যায়। স্ত্রীর চোখে এবার জলের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ল। সে করবেটা কী তাহলে? কাজের মেয়েটাতো বলতে গেলে বাড়ির সব কাজই করে দেয়। রান্নাঘরে গিয়ে ওর সাথে হাত লাগানোর মত যথেষ্ট কাজ রান্নাঘরে নেই। তবুও, সে সবসময় নিজের গরজেই সব ঘরদোর ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে। তাহলে, তার কাছে স্বামী চায়টা কী? সে কি চায় কাজের মেয়েটাকে বিদায়। করে দেয়া হোক?
না-না তা নয়।
তাহলে সে কী চায়?
আসলে সে যে কী চায়, তা নিজেও ভালো করে জানে না। তবে, সে নিশ্চিত, কোথাও একটা কিছু গন্ডগোল হচ্ছে। না-হলে সংসার-খরচ এত বেশি হবার কথা না। বর্তমানে যেভাবে চলছে সেভাবে চলা তাদের পক্ষে। খুব বেশিদিন সম্ভব হবে না। আর, তাছাড়া এতসব চিন্তায় নিজের গবেষণা প্রবন্ধের জন্যও সে তেমন একটা সময় দিতে পারছে না। এইসব চিন্তা করতে করতেই কিছুদিন যাবৎ মাথাটা একটু গরম হয়ে আছে।
যাহোক, স্বামীর স্বীকারোক্তির পর আবারও চোখের জল আর চুম্বন পরবর্তী শান্তি স্থাপিত হল। তবে, এরপর থেকে স্বামী ঘরের বাইরে অনেক বেশি সময় দিতে থাকল। সপ্তাহে বেশ কয়েকদিন সন্ধ্যার অনেক পর পর্যন্ত বাইরে থাকে। কারণ হিসেবে ঐ একটাকেই দাঁড় করানো হয় প্রতিবার ‘অফিসের কাজ। স্বামী অবশ্য ব্যাপারটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখে–পুরুষ মানুষের নিজের ঠাঁট বজায় রেখে চলা উচিত; ঘরে বেশি থাকলে নিজের দাম থাকে না, সবাই তখন সস্তা মনে করে এক সময় অবজ্ঞা করতে শুরু করে।
এভাবেই একটি বছর পার হল। তখনও পর্যন্ত তাদের সন্তান হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। স্বামীর আজকাল একটা কথা প্রায়ই মনে হয়: আগে যে বিভিন্ন মেয়ের সাথে পরিচয় ছিল এখন স্ত্রীর সাথে সম্পর্কটা অনেকটা সেরকমই হয়ে গেছে। তবে, পার্থক্য শুধু একটাই–যেটাকে নিয়ে সংসার করছে সেটা নিতান্ত নিবোধ, আর বেশি খরুচে।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এখন বলতে গেলে কোন কথাই হয় না। যতটুকু হয়। সেটা নিতান্তই প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা। স্বামীর মনে হয়, “এর। মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছু নেই। এর সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, যেন নিজের সাথেই কথা বলছি!” স্ত্রীর চোখের সৌন্দর্য, যেটা নিয়ে একসময় খুব উচ্ছ্বাস। ছিল, সেই সৌন্দর্যেরও সে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে, “ওটা আসলে মনের ভুল। ওর চোখের তারাগুলো একটু বড় বলেই ও রকম মনে হয়; আদতে, ওর চোখে কোন গভীরতাই নেই, যেমন নেই বুদ্ধিতেও।”
স্বামী একসময় প্রকাশ্যেই স্ত্রীর প্রতি তার এমন অনুভূতির কথা বলতে শুরু করল। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কথাগুলো এমনভাবে বলত যেন সেটা বহু আগেই ক্ষয়ে গিয়েছে। অবশ্য, যখনই এমন কথা বলত তখনই সে হৃদয়ে একরকম যন্ত্রণা অনুভব করত। একটা অস্বস্তিকর, নির্মম, অনুশোচনাহীন-যন্ত্রণা; যে যন্ত্রণার কোন নাম নেই।
তবে, এসব নিয়ে সে বেশ গভীরভাবে চিন্তা করেছে। একদিন সব কিছুই শেষ হয়ে যায়, এই হলো চিন্তা-পরবর্তী উপলব্ধি। তথাপি, সে আরও চিন্তা করতে থাকলো। সবকিছুই যদি একসময় রংহীন হয়ে যায়, তাহলে স্ত্রীর প্রিয় গানগুলোর ব্যাপারেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? “ঐ একই গান কাউকে যখন বছরে তিনশ পয়ষট্টি দিন শুনতে হয়, তখন তা পুরনো হতে বাধ্য। কিন্তু তাহলে কি এ কথাও সত্য যে, আমাদের ভালোবাসাও মারা গেছে?” স্ত্রীতো সে রকমই বলে। “না-না-না কিছুতেই না… অবশ্য…, হতেও পারে। আমাদের বিয়েটাতো এখন শুধু একটা বিশ্রী চুক্তি হয়েই আছে। আমাদেরতো কোন সন্তানই নেই।”