স্ত্রীর চিন্তা-ভাবনা যখন এই পর্যায়ে পৌঁছাল রাত্রি তখন সাড়ে দশটা। হঠাৎ করেই তার মনে হল–আচ্ছা, এমন চিন্তাতো আগে কখনো করিনি! সাথে সাথে আবার মন খারাপ হয়ে গেল। এবার আগের চেয়ে বেশি খারাপ হল। একে-একে নানা অসংগতি চোখে ধরা পড়তে লাগল: আরে! স্বামীকে আর আগের মত মধুরভাবে কথা বলে না, আগের মত গান গায় না, পিয়ানো বাজায় না। সর্বোপরি, স্বামী তার কাছে মিছে কথাও বলছে আজকাল। এইতো সেদিনই বলল, বিকালে না-ঘুমালে নাকি তার চলেই না; অথচ, কয়েকদিন ধরে সব সময়ই সে একটা ফ্রেঞ্চ নভেল পড়ছে; এমনকি বিকেলেও! ওফ! স্বামী তাকে মিথ্যা বলেছে!
এতসব চিন্তা করতে করতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজল। চারদিকের সুনসান নীরবতা এখন গায়ে কাঁটা হয়ে ফুটছে। কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। স্ত্রী উঠে গিয়ে জানালা খুলে রাস্তায় তাকালো। দুটো লোক দুটো মেয়ের সাথে দর কষাকষি করছে। হুম! এটাই তাহলে পুরুষের আসল চরিত্র! আচ্ছা, তার স্বামী যদি কখনো এমন করে? ভাবতেই গা শিউরে উঠল। স্বামী এমন করলে সে নিশ্চিত আত্নঘাতি হবে! ঝট করে জানালা বন্ধ করে দিয়ে সোফার ওপর বসে পড়লো স্ত্রী। মনে পড়ল, স্বামী একবার তাকে বলেছিল: “যে যেমন ভাবে, সে তেমনই দেখে।” সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু যেন পরিবর্তিত মনে হল। চারপাশের সবকিছু কেমন নতুন, ঝা চকচকে দেখাচ্ছে! বিছানার ওপর সবুজ চাদরটাকে মনে হচ্ছে যেন সবুজে ছাওয়া কোন নির্মল মাঠ, আর তার ওপর রাখা বালিশ দুটো যেন ঘাসের ওপর শুয়ে থাকা ছোট্ট দুটো আদুরে বেড়ালছানা! ঘরের সব আসবাবের রোশনাই যেন দ্বিগুন হয়ে গেছে, দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটার ওপর যে ছোপ-ছোপ দাগ ছিল সেগুলোও আজ উধাও! চিরুনি, পাউডার বক্স আর টুথব্রাশের গোড়ায় লাগানো রূপার প্রলেপ যেন আজ সোনার মত ঝকঝক করছে! এমনকি ঘরে পড়ার জুতো জোড়াও এমন নতুন আর চমৎকার লাগছে যে, ভাবাই যাচ্ছে না ওগুলো পায়ে পরার জিনিস! ওহ্! চারপাশে সবকিছু কত সুন্দর, কত নতুন, কিন্তু… কিন্তু প্রাণের ছোঁয়াটা যেন একটু কম। স্বামীর সবগুলো গান তার জানা, সব কথা, এমনকি সব চিন্তাও তার পরিচিত। খেতে বসার আগে স্বামী কী বলবে, সন্ধ্যাবেলায় ঘুরে বেড়ানোর সময় কী বলবে, সব তার বোঝা হয়ে গেছে। একই কথা, একই সবকিছু দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত। আচ্ছা, কখনো কি সে ঐ লোকটির প্রেমে পড়েছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই পড়েছিল। তাহলে কি এই কথাগুলো, এই আচরণগুলোরই প্রেমে পড়েছিল? একটা মেয়ে হিসেবে সে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিল সেগুলো মনে করার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ, তার স্বপ্নগুলোও মোটামুটি এমনই ছিল। তাহলে কি মৃত্যু পর্যন্ত এই বৃত্তাকার পথেই জীবন চলতে থাকবে? হয়তো তাই। কিন্তু… কিন্তু… ইয়ে,… মানে,… তাদের বাচ্চা-কাচ্চা তো হবে এক সময়, তাই না? স্ত্রীর মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। যদিও এখনও পর্যন্ত এমন কোন সম্ভাবনা দেখা যায়নি, তবু হবেতো এক সময়। তখন তাকে আর এমন একাকী সময় কাটাতে হবে না। স্বামী তখন যখন খুশি বাইরে যাক, যখন খুশি ফিরুক, তাতে কিছু যায়-আসে না; তার নিজের তো কথা বলার, সময় কাটানোর একজন থাকবেই। হয়তো মাতৃত্বই তাকে সুখী করতে পারবে। একজন পুরুষের বৈধ প্রেমিকা হয়ে থাকার চেয়ে মাতৃত্বের ব্যাপারটা অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ। ঐ সময়টা স্বামী তাকে ভালো না-বেসে পারবেই না। অথচ, এখন সে আর আগের মত ভালোবাসে না!
এসব চিন্তা করতে করতে স্ত্রীর চোখ ছলছল করে উঠল, ঝুরঝুরিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল।
স্বামী বাড়ি ফিরল রাত একটায়। এতক্ষণ কান্নাকাটি করে স্ত্রী এখন অনেকটা শান্ত। কিন্তু তাকে এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে দেখে স্বামী বেশ রেগে গেল। তার প্রথম কথাটাই হল এমন–“এত রাত হয়েছে তবু ঘুমাতে যাওনি কেন?”
–দেখতেইতো পাচ্ছ, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষা করা মানুষ ঘুমায় কীভাবে?
–বাহ! চমৎকার যুক্তি, তো আমি কি তাহলে বাইরেও যেতে পারবো?
এ কথা জিজ্ঞেস করেই স্ত্রীর দিকে ভালো করে তাকালো স্বামী–“তুমি কি এতক্ষণ কান্না করছিলে?”
“হুম! করবো না কেন? তুমিতো আমাকে আর আগের মত ভালোবাসো না।” স্ত্রীর গলায় স্পষ্ট অভিমান।
–মানে কী? আমাকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল বলেই কি তোমার মনে হল তোমাকে আর আগের মত ভালোবাসি না?
“রাতে বাইরে খাওয়াটা অফিসের কাজ হতে পারে না” ঠোঁট উল্টে স্ত্রীর প্রতিবাদ।
–হায় ঈশ্বর! তাহলে কি আমি বাইরেই যাবো না? উহ! মেয়েরা কেন। যে এত অনধিকারচর্চা করে!
–অনধিকারচর্চা? তোমার প্রতি আমার অনুভূতিকে অনধিকারচর্চা মনে হল তোমার? আমার আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল। গতকালও তোমার অফিসে গিয়ে দেখা করার সময় এমন সন্দেহ হচ্ছিল। আর কখনোই তোমার সাথে দেখা করতে যাবো না।
স্বামী এবারে একটু হকচকিয়ে গেল–“ভুল বুঝোনা, সোনা! আমিতো আমার প্রধান…
উঁহু হু হু হু! স্ত্রী হাত-পা ছুঁড়ে কান্না জুড়ে দিল।
স্বামী বেচারা কী করবে ভেবে না-পেয়ে হৈচৈ করে কাজের লোককে ডেকে গরম পানির বোতল নিয়ে আসতে বলল। অথচ, আনার পর ধমক দিয়ে রুম থেকে বের করে দিল। তারপর, বোতল হাতে করেই হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কান্না দেখতে থাকলো। কিছুক্ষণ পর নিজেও অশ্রু বিসর্জন শুরু করল। গভীর, তিক্ত-বেদনাজাত অশ্রু। নিজের আচরণ, হৃদয়ের কঠিনতা, নানারকম শয়তানি, আর সর্বোপরি ভালোবাসার মোহময়তার কথা চিন্তা করে অশ্রু বিসর্জন করল সে। কিন্তু সূক্ষ বিচারে তার ভালোবাসাকে হয়তো ঠিক মোহ বলা যাবে না; কারণ সে তো সত্যিই স্ত্রীকে ভালবাসে, তাই না? হু! তা অবশ্য ঠিক। ওদিকে আবার স্বামী যখন হাঁটু মুড়ে বসে গোমড়ামুখো স্ত্রীর চোখের ওপর চুম্বন করছিল তখন স্ত্রীও তো বলছিল সে স্বামীকে ভালোবাসে, তাহলে? তাহলে কিছু না, তারা নিশ্চয়ই একে অপরকে ভালোবাসে। এতক্ষণ যেসব হচ্ছিল সেগুলো নিতান্তই কিছু কালো মেঘ। সে মেঘ এখন কেটে গেছে। আসলে, একাকী থাকার কারণেই এসব আজেবাজে চিন্তার উদ্রেক হয়। অতএব, স্ত্রী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, সে আর কখনোই একাকী থাকবে না। দুর্যোগের ঘনঘটা কাটিয়ে তারা একে অপরের বাহুলগ্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। স্ত্রীর গালে মিষ্টি হাসির টোল দেখা গেল।