তবে, বন্ধুরা যা-ই বলুক, প্রতি সন্ধ্যায়ই ছেলেটি কুমোরের বাড়িতে হাজির হয়। কুমোর ব্যাটা ভারী চালাক, কখন কাকে মত দিয়ে ফেলে বলা শক্ত। সন্ধ্যাগুলো তাই কুমোরের পরিবারের সাথেই কাটে–ভালোবাসাকে হারাতে দেবে না সে। আশেপাশে কেউ না-থাকলে, মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রেম নিবেদন করে। এ অভ্যাস অবশ্য আগে থেকেই তার রপ্ত করা ছিল। তবে, এসবের বাইরেও মেয়েটাকে খুশি করার জন্য সে নানারকম চেষ্টা করে–মেয়েটার সুই-সুতো নিয়ে খেলা করে, গান শোনায়, ধর্মীয় নানা কাহিনি বলে, নাটকের গল্প শোনায়। আর, এ সবকিছুতেই সে মেয়েটার চোখে মৌনসম্মতি দেখতে পায়। ফলে তার উচ্ছ্বাস আরও বেড়ে যায়–মেয়েটাকে ভালোবাসার কবিতা লিখে উপহার দেয়, পড়ে শোনায়। আর… আরও অনেককিছু। এভাবেই ধীরে ধীরে ছেলেটি তার ভালোবাসার মন্দিরে নিজের গর্ব, অহংকার, বোধ, উচ্চাভিলাষ সবকিছু উৎসর্গ করল, এমনকি নিজের গবেষণা-প্রবন্ধটিও। কিছুদিন পর তাদের বিয়ে হল।
বিয়ের দিন কুমোরের খুশি যেন আর ধরে না। গলা অব্দি মদ পান করল। মদ্যপ অবস্থায় নারীজাতি সম্পর্কে নানা অশালীন মন্তব্য, আর চটুল রসিকতা করে এক বক্তৃতা দিল। কুমোরের জামাই কিন্তু তাতে মোটেও অসন্তুষ্ট হল না। সে বরং এগুলোকে একরকম সহজ-সরল, খোশমেজাজি আচরণ বলে ধরে নিয়ে শ্বশুরকে আরও প্ররোচিত করতে থাকল। তার মনে হল, এই সাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে নিজেকে আজ খুব হালকা লাগছে।
ওদিকে বন্ধুরা বলল–“ভালোবাসা, এরই নাম ভালোবাসা! ভালোবাসায় সবই সম্ভব!”
*** *** ***
এতদিনে দুজন-দুজনার। আর কোন দূরত্ব বা বাধা নেই। এক মাস গেল, দু’মাস গেল। সময় যে কোন দিক দিয়ে যাচ্ছে তার কোন গাছ-পাথর নেই…
ছেলেটি খুশিতে আত্মহারা–কী ছেড়ে কী করবে তা-ই ভেবে পায় না। সন্ধ্যার সময়টা দুজন একসাথে কাটায়। ছেলেটি মেয়েটিকে গান গেয়ে শোনায়, মেয়েটির প্রিয় ‘বুনো গোলাপ ফুলের গান। গান শেষ হলে ধর্মকাহিনি আর নাটকের গল্প বলে। মেয়েটি বেশ আগ্রহ নিয়ে সব গল্প শোনে। কিন্তু কখনোই কোন মন্তব্য করে না। চুপচাপ শুনে যায়, আর কাপড়ের ওপর সুঁই-সুতোয় ফুল তোলে।
বিয়ের তৃতীয় মাসে স্বামী-স্ত্রীর অভ্যাসে খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল–স্বামী তার বিকেলবেলা ঘুমানোর পুরনো অভ্যাসে ফেরত গেল। স্ত্রীর কিন্তু একা থাকতে মোটেই ভালো লাগে না, স্বামীর পাশে বসে খুঁটখাঁট করে। স্বামী তাতে খানিকটা বিরক্তই হয়। নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলো গুছানোর জন্য কিছুটা একাকীত্ব প্রয়োজন তার। স্ত্রী মাঝে মাঝে স্বামীর অফিস ফেরার পথে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময়টা তার খুব গর্ব হয়। সহকর্মীদের ছেড়ে, রাস্তা পার হয়ে এসে স্বামী তার হাত ধরছে, এই চিন্তাটা ভীষণ আনন্দ দেয়। বিজয়িনীর বেশে স্বামীকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।
চতুর্থ মাসে স্ত্রীর প্রিয় গানটার ওপর স্বামী পুরোপুরি বিরক্ত হয়ে উঠল। এক গান আর কত গাওয়া যায়! সে বরং একটা বই টেনে নিয়ে পড়তে থাকে। দুজনের মধ্যে তেমন কথাবার্তা হয় না।
*** *** ***
এক সন্ধ্যায় স্বামীকে একটা মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য যেতে হল। সেখানে রাতের খাবারের আয়োজনও ছিল। বিয়ের পর এই প্রথম সে দীর্ঘ সময়ের জন্য রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে যাচ্ছে। স্ত্রীর বেশ মন খারাপ। স্বামী তাকে অনেক করে বোঝালো। বলল, সন্ধ্যার সময়টা যেন সে আশেপাশের কোন বান্ধবীর সাথে গল্প করে কাটায়, আর রাতে যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। কারণ, সব কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হয়ত গভীর রাত হয়ে যাবে।
সন্ধ্যায় স্ত্রীর এক বান্ধবী এল। রাত্রি নয়টা পর্যন্ত তারা নানা গল্পগুজব করল। সময় যেন কাটতেই চায় না। বান্ধবী এক সময় চলে গেল। সময় এবার আরও শভুকগতিতে চলছে। কিন্তু স্ত্রীও প্রতিজ্ঞা করেছে, স্বামী না ফেরা পর্যন্ত ঘুমুতে যাবে না। ড্রইংরুমে সোফার ওপর এককোণায় বসে রইল। শরীরে ক্লান্তি এলেও মনের অস্থিরতার কারণে ঘুম আসছে না। অতএব, ওভাবেই বসে থাকতে হল। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? সময়তো কাটছেই না! কী করা যায়? কাজের লোকের ঘরে উঁকি দিয়ে। দেখল–অঘোরে ঘুমুচ্ছে। পুরনো ঘড়িটা টিক-টক শব্দ করছে। কী করা যায়? সুইসুতো নিয়ে বসল কিছুক্ষণ। তাতেও মন বসাতে পারল না। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো মাত্র দশটা বাজে। নাহ্! আরতো ভালো লাগছে না। এবার শুরু হল ঘরময় অস্থির পায়চারি। আসবাবপত্র টানাটানি করে। এপাশ-ওপাশ করল। এতসব করেও যখন কিছুতেই সময় যাচ্ছে না, স্ত্রী। তখন রীতিমত অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। আচ্ছা! বিয়ের মানে তাহলে এই? একটা মেয়েকে তার পরিবার-পরিজন থেকে দূরে সরিয়ে এনে তিন রুমের একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হবে, আর মেয়েটি স্বামী না-ফেরা পর্যন্ত ঘুম ঘুম চোখে অপেক্ষা করবে, তাই না? উহ! অসহ্য!
কিন্তু এটাতো ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বামী তাকে ভালোবাসে, যথেষ্ট ভালোবাসে। সে তো অযথা বাইরে গিয়ে ঘোরাঘুরি করছে না; গেছে। অফিসের কাজে। এসব নিয়ে স্বামীর ওপর রাগ করাটা কি নিছক বোকামি নয়? হুম! কিন্তু স্বামী কি সত্যিই এখনো তাকে ভালোবাসে? এইতো দু’একদিন আগেই স্ত্রী যখন তাকে সুতার কাঠিমটা ধরে থাকতে বলল কই স্বামীতে রাজি হল না। অথচ বিয়ের আগে সুতার কাঠিম ধরে রাখাটা তার প্রিয় কাজ ছিল! আরও আছে, গতকাল লাঞ্চের আগে স্বামীর সাথে একবার দেখা করতে যাওয়ায় স্বামী ভুরু কুঁচকে ছিল, না? হ্যাঁ, স্পষ্ট দেখেছে সে! তবুও, সব কিছু না-হয় ছাড়া গেল, কিন্তু এই যে আজ সে মিটিংয়ে গেল, মিটিংয়ের পর রাতে সেখানে খাওয়ার দরকারটা কী?