–তারপর? তারপরের কথাতো আর আপনাকে বলা যাবে না!
–আচ্ছা, বেশ। তা, তার পরে কী হল?”
তার পর? তার পর, যেহেতু সব ঠিকঠাক হয়ে গেল, আমরা সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করলাম। কীভাবে ওদেরকে যাবতীয় কুসংস্কার আর ফালতু চিন্তা-ভাবনা থেকে দূরে রেখে সুস্থ সুন্দর জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করা যায় তা নিয়ে কথা বললাম। ঠিক করলাম–যখন আমরা একসঙ্গে থাকবে শুধুমাত্র তখনই এসব নিয়ে আলোচনা করব; একাকী কিংবা অন্য কারো সঙ্গে এসব নিয়ে কখনো কথা বলব না, কারণ তাতে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থাকে। কী বলেন আম্মা, ঠিক বলেছি না?
–আমি আর কী বলবো! যা বলার তোমাদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েই বলবো।
–অবশ্যই, অবশ্যই দাওয়াত খেতে আসবেন। আপনি সেখানে পুতুলের নাচ দেখতে পাবেন, ছোট্ট পাখির গান শুনতে পাবেন, আরও শুনতে পাবেন কাঠঠোকরার কিচিরমিচির। আপনি এমন একটা ঘর দেখতে পাবেন যার ছাদ পর্যন্ত সুখ দিয়ে ঠাসা। কারণ সে ঘরে কেউ রূপকথার অলৌকিকতার অপেক্ষায় বসে থাকে না, সে-ঘরে সবাই ভালোবাসা দিয়েই সব শিখিয়ে দেয়। সে ঘরে আপনি সত্যিকারের একটা পুতুলের সংসার দেখতে পাবেন।
ক্ষতিপূরণ
কলেজের সবাই ‘জিনিয়াস’ বলে জানত। একদিন যে নিজেকে আলাদা করে চেনাবেই সে ব্যাপারে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করার পর ছেলেটি স্টকহোমে ফিরে যেতে বাধ্য হল। সেখানে জাহাজ জেটিতে কাজ নিতে হলো। ডক্টরেট ডিগ্রি পাবার জন্য যে গবেষণা-প্রবন্ধ তৈরি করছিল, সেই কাজও আপাতত বন্ধ রাখতে হলো। কামাই-রুজির বন্দোবস্ত খুব একটা ভালো না-হলেও মনে মনে সে ভীষণ উচ্চাভিলাষী। চিন্তা করে দেখলো, এই উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নে বিয়ে করাটা খুব কাজে দেবে। কারণ, যুতসই একটা বিয়ে করতে পারলে টাকা-পয়সার জন্য আর ফিরে তাকাতে হবে না। তাই সে বেছে বেছে নামী-দামী পরিবারগুলোর সঙ্গেই বেশি খাতির জমাতো। উপছালা (এখানে সে আইনে পড়েছে) এবং স্টকহোম দু জায়গাতেই তার একই রকম পরিকল্পনা ছিল। উপছালায় পড়াকালীন সব সময় সে তক্কে তক্কে থাকতো কারা নতুন ভর্তি হল। কোন অভিজাত ঘরের সন্তান ভর্তি হবার খবর পাওয়ামাত্র তার সঙ্গে ভীষণ ভাব জমিয়ে ফেলত। সেই অভিজাত সন্তানটিও খুব শীঘ্রই তার চাটুকারিতাকে পছন্দ করতে শুরু করত। এভাবে অনেকের সাথেই তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রয়োজন মেটানোর মত সুসম্পর্ক। গ্রীষ্মের ছুটিতে সে এসব অভিজাত বন্ধুদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেত।
এই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার উপলক্ষটা ছিল উদ্দেশ্য পূরণের একটা মোক্ষম সুযোগ। প্রকৃতিগতভাবেই ওর মধ্যে সব ধরনের সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটেছিল। সবার সঙ্গে খুব সুন্দর করে মিশতে পারত, গানের গলাও ছিল চমৎকার। বিভিন্ন খেলাধুলায় পারদর্শিতার পাশাপাশি মেয়ে পটানোর কাজটাও বেশ ভালোই জানা ছিল। ফলে নারীমহলে ও ছিল এক জনপ্রিয় চরিত্র। পকেটের অবস্থা যা-ই-হোক না কেন, কাপড়-জামা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। দামী পোশাকআশাক পড়ে ফুলবাবুটি সেজে চলাফেরা করত! অবশ্য, এজন্য ও কখনোই বন্ধুবান্ধব বা অন্য কারো থেকে টাকা ধার করত না। কীভাবে কীভাবে যেন ম্যানেজ করে ফেলত। নিজের। ফুটানি জাহির করার সম্ভাব্য সবগুলো উপায়ই ও ব্যবহার করত। যেমন, হয়ত খুব আজেবাজে দুটো কোম্পানির শেয়ার কিনল, তারপর যখনই সুযোগ পাবে তখনই বলে বেড়াবে যে, তাকে শেয়ারহোল্ডারদের বাৎসরিক মিটিংয়ে যেতে হবে!
গত দু’বছর যাবত ছেলেটিকে এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ের পেছনে সময় দিতে দেখা যাচ্ছে। মেয়ের বাপের টাকা-পয়সা বিস্তর, এবং সেগুলো হস্তগত করাটাই যে তার প্রধান উদ্দেশ্য, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু হঠাৎ এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল! যাবতীয় জাঁকজমক থেকে হুট করে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল ছেলেটা। কিছুদিন পর জানা গেল, এক দরিদ্র কুমোরের মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক হয়েছে, এমনকি বাগদানও হয়ে গেছে। বন্ধুরা কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারল না। ওর মত উচ্চাভিলাষী ছেলে কীভাবে এ-কাজ করল তার কোন আগাপাছতলা খুঁজে পেল না। তারা–“ওর সব পরিকল্পনাইতো গোছালো ছিল। ও এত সূক্ষ্ম চাল চেলে এগুলো যে সাফল্য ধরা দেয়া শুধু কটা দিন সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। চামচে খাবার তুলে নেয়া হয়েছে, এখন শুধু সেটা গলাধঃকরণ বাকি, অথচ…!” অবশ্য ও নিজেও বুঝতে পারল না কীভাবে কী হয়ে গেল। স্টিমারে ফেরার সময় ছোটখাটো একটা মেয়েকে দেখে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল, এতদিনের পরিকল্পনা সব ভেস্তে গেল। মেয়েটাকে দেখার পর। থেকেই মনে হচ্ছিল, কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। যাহোক, নিজেকে প্রবোধ মানানোর জন্যই হয়ত বন্ধুদের। জিজ্ঞেস করল, “তোদের মনে হয় না মেয়েটা সুন্দরী?”
বন্ধুরা অকপটে স্বীকার করল, তাদের সে রকম কিছু মনে হয়নি!
“কিন্তু ও ভীষণ বুদ্ধিমতী। একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখিস, ওর চোখের তারায় এক দুর্বোধ্য অভিব্যক্তি চোখে পড়বে তোদের!”
বন্ধুরা এবারেও তাকে হতাশ করল। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের বিশেষ কিছু মনে হয়নি। আর, বুদ্ধির কথা বলা যাচ্ছে না; কারণ তারা কখনোই মেয়েটিকে মুখ খুলতে দেখেনি!