*** *** ***
এক সপ্তাহ পর ক্যাপ্টেনকে আবার শাশুড়ির বাড়িতে দেখা গেল। আজ বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে তাকে। ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে গ্লাস ভরে ‘শেরী’ পান করছেন। সবকিছু মিলিয়ে ক্যাপ্টেন যেন আজ এক নতুন প্রাণে টগবগ করছেন। তাঁর বৃদ্ধা শাশুড়ি কপালের ওপর চশমা তুলে বললেন, “এবার বিস্তারিত বল।”
ক্যাপ্টেন সাহেব শুরু করলেন–শুরুতে কাজটা একটু জটিল মনে হচ্ছিল, কারণ, ওটিলিয়া আমাকে বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিল না। ভেবেছিল, আমি বোধহয় ওকে নিয়ে ঠাট্টা করছি। যাহোক, কিছুক্ষণ পর আমি বেশ কায়দা করে একটা পরিসংখ্যানের কথা বললাম। আমেরিকানদের নৈতিকতার ওপর করা একটা সম্ভাব্য হিসাব নিয়ে বলতে শুরু করলাম। এ হিসেবের ফল কী হয়েছিল সেটা বলতে গিয়ে বেশ একটু ধোঁয়াশা সৃষ্টি করলাম। তারপর খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে বললাম, এই পরিসংখ্যানের ফলাফল রীতিমত নতুন এক যুগের সৃষ্টি করেছিল। ওটিলিয়ার এ ব্যাপারে কোন ধারণা না-থাকলেও ব্যাপারটা ওর মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে বোঝা গেল। আমিও সুযোগ কাজে লাগালাম। নানারকম উদাহরণ দিয়ে, ছবি এঁকে বোঝালাম, কত ভাগ নারীর পতিত হবার সম্ভাবনা আছে সেটা সম্ভাব্যতার
কিছু সূত্র প্রয়োগ করে খুব সহজেই দেখিয়ে দেয়া সম্ভব। এইবেলা ওকে একটু বিস্মিত মনে হল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর উৎসাহ বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পরদিন ও আবার দেখা করতে রাজি হল। ওদিকে, ওটিলিয়ার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হচ্ছে দেখে গুরলীকেও ভীষণ খুশি মনে হল। খুশি হয়ে ও যে কাজগুলো করল সেগুলো আমার পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে অনেকটা কাজে এল–ওটিলিয়াকে আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে দরজা টেনে দিয়ে গেল গুরলী! আমরা ওই রুমেই সারা বিকেল কাটালাম। নানা হিসেবপাতি করলাম। ডাইনিটাকে খুব খুশি মনে হচ্ছিল। ও বোধহয় ভাবছিল, আমাকে বেশ পোষ মানানো গেছে। যাহোক, প্রায় তিন ঘণ্টা কাজ করার পর আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম! রাতে খাবার টেবিলে বসে গুরলী দেখলো আমরা পুরনো বন্ধুদের মত একে অপরকে খ্রিস্টান নাম ধরে ডাকছি। ব্যাপারটায় আরেক প্রস্থ রং চড়ালাম আমার পুরনো শেরীর বোতল বের করে এনে খুব ঘটা করে এই মুহূর্তটাকে উদযাপন করলাম। তারপর… তারপর আমি ওর ঠোঁটে চুম্বন করলাম। ওহ! ঈশ্বর যেন আমার অপরাধ ক্ষমা করেন। গুরলী শুরুতে একটু হকচকিয়ে গেলেও রাগ করল বলে মনে হল না। বরং, একটু যেন খুশিই মনে হল।
শেরীটায় বেশ ঝাঁঝ ছিল। ওটিলিয়ার পক্ষে অতটা সহ্য করা সম্ভব ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও একেবারে নেতিয়ে পড়ল। আমি ওকে ওর কোট দিয়ে ভালো করে জড়িয়ে বাড়িতে দিয়ে আসার জন্য উঠলাম। যাবার সময় আলতো করে ওর হাত ধরে এগুচ্ছিলাম আর আকাশের বিভিন্ন তারকাদের নাম বলছিলাম। এ ব্যাপারেও ওর আগ্রহ আছে দেখা গেল। ছোটবেলা থেকেই ও নাকি তারকা দেখতে পছন্দ করে, কিন্তু কখনোই সেগুলোর নাম মনে রাখতে পারে না। অবশ্য এমন নচ্ছার মহিলারা কোন বিষয়েই ভালো করে কিছু জানতে পারে না; কেবল পুরুষ মানুষের দোষ খুঁজে বেড়াতেই সময় চলে যায়। যাহোক, ওর আগ্রহ বাড়তেই থাকলো। ওকে বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় এমনভাবে বিদায় নিলাম যে, কেউ দেখলে ভাববে আমরা হয়ত অনেক দিনের পুরনো বন্ধু কিন্তু মাঝে কিছুদিন ভুল বোঝাবুঝির কারণে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল না!
পরদিন আবারও বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হল। রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত আমরা একসাথে কাজ করলাম। মাঝে দু’একবার গুরলী এসে ‘হুঁ’, ‘হ্যাঁ’ করে গেল। খাবার টেবিলেও আমরা গণিত আর তারকা বিষয়ক কথাবার্তা বললাম। আমি ইচ্ছে করে এমন সব জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম যে, গুরলীর কিছুই বলার ছিল না, ও। চুপচাপ শুধু আমাদের কথা শুনে যাচ্ছিল। খাওয়া শেষে আগের দিনের মতই ওটিলিয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলাম। ফেরার পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। দুজন মিলে গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়ে ‘পাঞ্চ’ পান করলাম। বাড়ি ফিরতে রাত একটা বেজে গেল। গুরলী তখনো জেগে ছিল, আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাড়ি পৌঁছামাত্র গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করল, “এতক্ষণ কোথায় ছিলে, উইলিয়াম?” আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল, বললাম–“আমাদের একে-অন্যকে এত বেশি কথা বলার ছিল যে, অন্য সবকিছু ভুলেই গিয়েছিলাম।” এইবার মনে হল ওষুধে ধরেছে। গুরলী আগের চেয়েও থমথমে গলায় বলল, “অর্ধেক রাত পর্যন্ত কোন মহিলার সাথে বাইরে কাটানোটা কোন ভাল কাজ বলে আমার মনে হয় না।” আমি একটু অস্বস্তিতে পরার ভান করলাম। তারপর, তোতলাতে তোতলাতে বললাম, “একজন মানুষের যদি অন্য একজন মানুষকে এত বেশি কথা বলার থাকে তাহলে কোনটা ভালো কাজ আর কোনটা না, তা খেয়াল থাকে না।” গুরলী এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা দুনিয়ার কোন মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তোমরা এতক্ষণ কথা বললে?” আমার অভিনয়টাকে আর একটু জমিয়ে নিয়ে বললাম, “তা তো মনে নেই!”
ক্যাপ্টেনের শাশুড়ি এবার একটু দম নিলেন। “হুম, ভালোই ম্যানেজ করেছ দেখা যাচ্ছে। তারপর কী হল?”
ক্যাপ্টেনও একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন–
তৃতীয় দিন আমরা গাণিতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সময় গুরলী ওর সেলাইফোঁড়াই এর কাজ নিয়ে আমাদের পাশে এসে বসল। আমাদের আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওখানে বসেই কাজ করল। রাতে খাবার টেবিলে আগের দু’দিনের মত অতটা আনন্দফুর্তি না হলেও জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনাটা ঠিকঠাকমতই হল। বেরুবার সময় আমি ডাইনিটার গামবুটের ফিতা বেঁধে দিলাম। ব্যাপারটা গুরলী বেশ বাঁকা চোখে দেখল বোঝা গেল। বুট পরা শেষে উঠে দাঁড়িয়ে শুভরাত্রি বলার সময় ডাইনিটা আমার দিকে গাল এগিয়ে দিল। গুরলী যে মনে মনে রাগে। জ্বলছিল বাইরে থেকেও সেটা আমি বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। যাহোক, যথারীতি ডাইনিটাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্য হাত ধরে সাথে নিয়ে বের হলাম। পথে যেতে যেতে মৃতদের আত্মার শান্তি নিয়ে কথা বললাম। দেখা গেল এ বিষয়েও ডাইনিটার আগ্রহ এবং হতাশা আছে। আমি বলতে। থাকলাম, “জানো তো, তারকাদের মধ্যেই আত্মারা বসবাস করে।”