স্ত্রী এবার স্বামীর বক্তব্যের লাগাম টেনে ধরলো, “উইলিয়াম, আমার মনে হয় আমরা মূল আলোচনা থেকে সরে যাচ্ছি। আলোচনা হচ্ছিল আমাদের ভালোবাসা নিয়ে। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা যেমন হওয়া উচিত আমাদের ভালোবাসা কখনোই তেমন ছিল না। বরং, আমাদের ভালোবাসা ইন্দ্রিয়সুখের উপলক্ষ হয়েছে মাত্র।”
–কিন্তু সোনা, এই ইন্দ্রিয়সুখের উপলক্ষ না থাকলে আমাদের সন্তানগুলো কীভাবে হত, বলতো? আর তাছাড়া আমি বিশ্বাস করি না এখানে শুধু ইন্দ্রিয়সুখই কাজ করেছে।
“তুমি বিশ্বাস না করলেই তো আর সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না। কোন জিনিস কি কখনো একই সাথে সাদা, কালো দুটোই হতে পারে?” প্রশ্নটা করে স্ত্রীর মনে হল স্বামীকে বেশ বেকায়দায় ফেলা গেছে।
স্বামী কিন্তু ঠিকঠাক মত উতরে গেল–“অবশ্যই পারে। তোমার সানশেডের কথা চিন্তা কর, এটার বাইরে কালো আর ভেতরে সাদা।”
এত দ্রুত উত্তর পেয়ে যাবে আশা করেনি স্ত্রী। স্বামীকে নিরস্ত্র করলো সে–“কূটতর্ক কর না।”
–ঠিক আছে করলাম না। কিন্তু লক্ষ্মীসোনা! আমাকে বলোতো, তুমি নিজে মন থেকে কী বিশাস কর? ওটিলিয়ার ওইসব ছাইপাশ বইয়ের মত কথা বল না, নিজের বুদ্ধিকে অন্যের কাছে বিক্রি কর না। প্লিজ, নিজের মত করে চিন্তা কর, আমার লক্ষ্মী বউয়ের মত চিন্তা কর। আমাকে বল, তুমি নিজে তোমার অবস্থান কেমন বলে মনে কর।
–তোমার সম্পত্তি বলে মনে করি। তুমি তোমার পরিশ্রমের বিনিময়ে এই সম্পত্তি কিনে নিয়েছ।
–একদম ঠিক কথা। তুমি আমার সম্পত্তি। ঠিক যেমন আমিও তোমার সম্পত্তি। তোমার একার সম্পত্তি। তোমার স্বামীর ওপর আর কোন মেয়েলোকের কোনও অধিকার নেই। কেউ অধিকার দাবি করলে তুমি নিশ্চয়ই তাকে আস্ত রাখবে না, তাই না? এই সম্পত্তি তোমার স্বামী তোমাকে উপহার দিয়েছে; কিংবা বলা যায়, তোমাকে সম্পত্তি হিসেবে পাবার জন্য সে নিজেকে তোমার সম্পত্তিতে পরিণত করেছে। আমি কি বোঝাতে পারলাম? এবার কি আমরা থামতে পারি?
দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণের নিরবতা বিরাজ করল। তারপর স্ত্রী আবার হতাশ ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল–“কিন্তু আমরা আমাদের জীবনটা শুধু ক্ষুদ্র জিনিসের পেছনেই ব্যয় করেছি, উইলিয়াম। আমাদের জীবনের। কখনোই কোনো মহান উদ্দেশ্য ছিল না।”
–কে বলেছে ছিল না? অবশ্যই ছিল এবং আছে। আমরা সবসময় এমন হেসেখেলে সময় পার করিনি; অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। চিন্তা করে দেখ, আমরা কি আমাদের প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখতে নতুন প্রজন্মের জন্ম দিইনি? এদের জন্ম দিতে গিয়ে চারবার তোমাকে মৃত্যুঝুঁকি নিতে হয়েছে, এদের ঘুম পাড়ানোর জন্য তোমার নিজের রাতের ঘুম চুরি গেছে, দেখাশোনা করার জন্য মাটি হয়েছে দিনের আনন্দটুকুও। এদের খাওয়াতে গিয়ে আমরা নিজেরা না খেয়ে থেকেছি, কঠিন থেকে কঠিনতর পরিশ্রম করেছি। আমাদের এই ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়েই তো এরা বড় হয়ে উঠছে, তাই না? আমরা স্বপ্ন দেখি, ওরা একদিন আদর্শ নারী আর পুরুষে পরিণত হবে। ভেবে দেখতো, আমরা যদি কোন মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সন্তানদের জন্য এই ত্যাগগুলো স্বীকার না করতাম, তাহলে। কি আজ আমাদের ছয় রুমের অভিজাত একটা ফ্ল্যাট থাকতে পারত না? সেই ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দেয়ার জন্য থাকত দারোয়ান, সিল্কের কাপড় আর মণিমুক্তার দামী গহনা পরে তুমি ঘুরে বেড়াতে পারতে; আমাকেও দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে হত না, হয়ত তোমাকে নিয়েই সারাক্ষণ মেতে থাকতে পারতাম। কিন্তু তা না-করে আমরা এভাবে কষ্ট সহ্য করছি শুধুমাত্র আমাদের ভালোবাসার ওপর আস্থা রেখেইতো, তাই না? একে কি কোনভাবে পুতুলের সংসারের সাথে তুলনা করা যায়? নাকি সেটা ঠিক? ওই অবিবাহিতা বুড়ি মহিলারা যেভাবে চিন্তা করে আমরা কি আসলেই তেমন স্বার্থপর? ওদের কথায় কি আসলেই অতটা গুরুত্ব দেয়া উচিত, বলো তো? একবার চিন্তা করে দেখ–কেন? কিসের আশায় এত এত মহিলা অবিবাহিত থাকছে? কেউ যখন ওদের বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন ওদের গর্বের সীমা থাকে না, অথচ ভাব দেখায় এমন যেন বিয়ে না করে বিরাট আত্মত্যাগ করে ফেলেছে! আর মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ল্যাটিন শেখার কথা বলছিলে তো? বড় গলার জামা পরে পরহিতকর কাজ করার নামে, নিজের সন্তানদের অবহেলিত রেখে ঘর ছেড়ে যাওয়াটা কোনভাবেই মহান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোন কাজ হতে পারে না; বরং, দায়িত্ববোধের চরম অভাব থাকলেই এমনটা হতে পারে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের জীবনের লক্ষ্য ওই ওটিলিয়ার লক্ষ্যের থেকে অনেক মহান। আমি বিশ্বাস করি, আমরা এমন শক্ত-সমর্থ, যোগ্য পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে যাবো যারা আমাদের ব্যর্থতাগুলোকে সফলতায় পরিণত করবে। আর এতে যে আনন্দ, সেটা ওটিলিয়া কখনোই বুঝবে না। ওর ল্যাটিন ওকে এক্ষেত্রে কোন সহযোগিতাই করতে পারবে না। যাহোক, অনেক কথা বলে ফেললাম, আমাকে আবার জাহাজে ফিরতে হবে। তুমি কি আমার সাথে উঠবে গুরলী?
স্ত্রী কোন উত্তর না-করে আগের মতই পাথরের পাশে বসে রইল। অতএব স্বামী একাই রওনা দিতে উদ্যত হলেন। তাঁর পদক্ষেপ আজ একটু বেশিই ভারি মনে হচ্ছে। তাঁর সঙ্গে প্রকৃতিও যেন তাল মিলিয়ে ভারি হয়ে এল, নীল সমুদ্রের বুকে অন্ধকার নামল, সূর্যের উজ্জ্বলতাও নিভে এল। হাঁটতে শুরু করলেও স্বামীর মন কিন্তু ওই পাথরের পাশেই পড়ে ছিল। নিজেকে তিনি অনবরত প্রশ্ন করতে লাগলেন–“এ তুমি কোথায় যাচ্ছ, উইলিয়াম? কেন যাচ্ছ?” কবরস্থানের পাশের বেড়া অতিক্রম করার সময় তাঁর বুক ফেটে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল–ওহ্! আমি যদি ওইখানে ওই পাথরের পাশেই সারাজীবন শুয়ে থাকতে পারতাম, ওইখানেই যদি আমার কবর হত, কবরের পাশে কাঠ দিয়ে ক্রুশ বানানো থাকত। কিন্তু আমি জানি, ওকে ছাড়া সেই কবরে শুয়েও আমি সুখ পেতাম না! ওহ্! গুরলী! গুরলী!