–কিন্তু এটাতো সত্য যে, আমাদের সংসার একটা পুতুলের সংসারে পরিণত হয়েছে।
এবার গলায় একটু জোর দিলেন ক্যাপ্টেন সাহেব–“একমত হতে পারছি না। তুমি কখনো কোন দলিল জাল করনি, কোন ডাক্তারের কাছে হাঁটু উঁচু করে দেখাওনি যাতে পরবর্তীতে তাকে কাজে লাগানো যায়, রোমান্টিকতার নামে তুমি কখনো তোমার স্বামীর সাথে ভালোবাসার মিছে অভিনয় করনি, তুমি কখনোই এতটা বেকুব ছিলে না যে, তুমি সন্দেহ করবে যে দোষ তুমি না বুঝে করেছ তার জন্য তোমার স্বামী তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে; সর্বোপরি, তুমি কখনোই আমার কাছে মিথ্যে বলনি। আর আমিও তোমার কাছে সবসময়ই বিশ্বস্ত থেকেছি। হেলমার যেমন তার ব্যাংকে লোক নিয়োগের ব্যাপারে নোরার হস্তক্ষেপকে খারাপভাবে নেয়নি, আমিও তেমনি আমার সব ব্যাপারে তোমাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দিয়েছি। অতএব, আধুনিক বা সনাতন যে পদ্ধতিতেই বিবেচনা কর না কেন, আমাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, আমাদের বিয়ে পবিত্র বন্ধন।”
–মানছি তোমার কথা, কিন্তু তুমিও নিশ্চয়ই মানবে, আমি তোমার গৃহকর্মী ভিন্ন অন্য কিছু নই।
–ওহহহ! আবার! ক্ষমা কর, মানতে পারছি না। তোমাকে কখনোই। রান্নাঘরে বসে খেতে হয় না, তোমার নিজের বাড়িতে যে কাজগুলো তুমি। কর তা সামান্য কটা টাকার জন্য কর না, টাকা-পয়সা খরচের ব্যাপারে। তোমাকে কখনো হিসাব দিতে হয় না, তুমি কী করলে বা না করলে সে। জন্য তোমাকে বকা খেতে হয় না। আর তাছাড়া, আমাকে যেসব কাজ। করতে হয় সেগুলো একবার ভেবে দেখ–জাহাজের গতিপথ হিসাব করা, দড়ি-কাছি সামাল দেয়া, হেরিং মাছ আর মদের বোতল গুনে রাখা, আটা ময়দার বন্দোবস্ত করা; সর্বোপরি, তোমাদের ছেড়ে দূরে দূরে থাকা; এগুলো কি তোমার কাজের চেয়ে ভালো কিছু? তার চেয়ে তুমি বরং আস্ত একটা সংসার দেখাশোনা করছ, বাচ্চাদের বড় করে তুলছ, এগুলো কি বেশি গর্বের আর বেশি সম্মানজনক নয়?
–না, কোনভাবেই নয়। তোমার কাজের জন্য তোমাকে মাইনে দেয়া হয়, তুমি স্বাধীন, তোমার ওপর তোমার নিজের কর্তৃত্ব আছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, তুমি একজন পুরুষ মানুষ।
ক্যাপ্টেন এবার অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, “ওহহহ! তুমি কি সত্যিই চাও তোমার কাজের জন্য আমি তোমাকে মাইনে দিই? তুমি কি সত্যিই আমার গৃহকর্মী হতে চাও? ঠিক আছে, না হয় মানলাম পুরুষ হয়ে জন্ম নিয়ে ভুল করেছি। আজকাল তো পুরুষ হয়ে জন্ম নেয়াটা রীতিমত অপরাধ! কিন্তু এতেতো আমার কোন হাত নেই। সব প্রাণীর মধ্যে স্ত্রী এবং পুরুষ এই দুটো জাত থাকবেই; না হলে তো জগৎ থেমে যাবে। এই দুই জাতের মধ্যে যারা ঝগড়া লাগিয়ে দেয়ার উপক্রম করে তারা যেন নরকে যায়।”
শেষ কথাগুলো বলার সময় ক্যাপ্টেন সাহেবের গলায় আক্ষেপ ঝরে পরছিল। কিন্তু তার আরও কিছু প্রশ্নের জবাব দেবার ছিল
–আচ্ছা, তুমি দাবি করলে তুমি আমার গৃহকমী, অর্থাৎ আমি তোমার প্রভু; কিন্তু ভেবে দেখ তো, তোমার সাথে পরামর্শ না করে আমি কখনো কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি কি না। সবসময় আমরা মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিই না? বরং বলা যায়, তোমার অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমার কিছু বলারই থাকে না, তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই কর। বাচ্চাদের তুমি পুরোপুরি নিজের সিদ্ধান্তে বড় করছ না? সেবার তোমাকে বললাম, বাচ্চাটা ঘুমানোর সময় ওকে দোলা দিও না, ওতে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তোমার মনে হল, দোলা দেয়াটাই উচিত হবে। অর্থাৎ, আমরা পুরোপুরি বিপরীত সিদ্ধান্তে ছিলাম। এক্ষেত্রে আমাদের আপোস করার কোন উপায় ছিল না; কারণ দোলা দেয়া এবং না দেয়ার মধ্যবর্তী কোন অবস্থা নেই। অতএব, শেষ পর্যন্ত তোমার সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হল। আমি কি এসব নিয়ে কখনো কোন অভিযোগ করেছি?–করিনি। বরং এসব নিয়েই মিলেমিশে আমরা বেশ ভালো আছি। অথচ, ওই ওটিলিয়ার কথা শুনে আজ তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ!
“সবসময় শুধু ‘ওটিলিয়া’, ‘ওটিলিয়া কর কেন? তুমি নিজেই তো বলেছিলে ওকে জুটিয়ে নিতে।” বেশ ঝাঁঝালো গলায় কথাগুলো বলল স্ত্রী।
–মোটেও না। আমি কখনোই ওটিলিয়াকে জোগাড় করে নিতে বলিনি, বলেছিলাম একজন বান্ধবী জোগাড় করে নিতে। কিন্তু আমার কপাল যে এত খারাপ, তা কে জানত! এখনতো দেখা যাচ্ছে ওটিলিয়াই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
“তুমি সব সময়ই আমি যা পছন্দ করি তা থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাও।” স্ত্রীর গলায় স্পষ্ট বিরক্তি।
–আচ্ছা! তাহলে কি তোমার সব পছন্দ শুধু ওই ওটিলিয়াকে ঘিরেই? তোমার কথা শুনে কিন্তু তাই মনে হচ্ছে।
–তোমার যা-ই মনে হোক না কেন, ওটিলিয়ার এ বাড়িতে আসা বন্ধ করা যাবে না। ওকে আমি মেয়েদের ল্যাটিন শেখানোর দায়িত্ব দিয়েছি। তাছাড়া, মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার অন্যান্য ব্যাপারগুলোও ও-ই দেখে।
স্ত্রীর কথা শুনে আঁতকে উঠলেন স্বামী, “হায় ঈশ্বর! আমার মেয়েরা তো ধ্বংস হয়ে যাবে!”
–সে তুমি যা খুশি বলতে পারো; কিন্তু আমি চাই, একজন পুরুষ মানুষ যা কিছু জানে আমার মেয়েরাও তা জানুক, যাতে ওদের বিয়েটা হয় সত্যিকারের বিয়ে।
–কিন্তু সোনা, সব স্বামীতো ল্যাটিন জানে না। তাহলে তোমার মেয়েদের ল্যাটিন শেখানোর দরকার পড়ল কেন? এই আমাকেই দেখ, আমি তো ল্যাটিন বলতে শুধু ‘অ্যাবালেটিভ’ শব্দটাই জানি! তাতে কি আমাদের সংসারে সুখের কমতি পড়েছে কখনো? তাছাড়া, তুমি হয়ত জেনে থাকবে, ছেলেদের ল্যাটিন শেখানো বন্ধ করানোর জন্য সম্প্রতি একটা আন্দোলন হয়েছে। এর উদ্যোক্তাদের মতে, বাচ্চাদের এত গুরুগম্ভীর ভাষা শেখানোর কোন মানে হয় না। এতকিছুর পরও কি তুমি বুঝতে পারছ না? তোমার কি মনে হচ্ছে না, এসব শিখতে গিয়ে ছেলেরা ইতোমধ্যে ধ্বংসের দিকে যথেষ্ট পরিমাণ এগিয়েছে? এখন জোর করে ছেলেদের সমান হতে গিয়ে মেয়েদেরও কি সে পথে এগুতে হবে? ওহ্! ওটিলিয়া! ওকে পেলে। জিজ্ঞেস করতাম আমি ওর কী ক্ষতি করেছি? কেন ও আমার পিছে লেগেছে?