- বইয়ের নামঃ এ ডলস্ হাউস
- লেখকের নামঃ অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ
- প্রকাশনাঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ
- বিভাগসমূহঃ নাটকের বই, অনুবাদ বই
অপ্রাকৃতিক নির্বাচন
‘দ্য স্লেভস অব লাইফ’ বইটা পড়ে আমাদের ব্যারন [অভিজাতদের মধ্যে সর্বনিম্ন উপাধি] সাহেব প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছেন। বইটাতে তিনি পড়েছেন, “অভিজাত শ্রেণির শিশুরা হয়ত মারাই যেত যদি নীচু শ্রেণির কোন মা তাদেরকে বুকের দুধ পান না করাত।” ব্যারন সাহেব ডারউইনও পড়েছেন। সারমর্ম হিসেবে তাঁর মনে হয়েছে “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অভিজাত শ্রেণির শিশুরা ‘মানুষ’ প্রজাতির আরও উন্নত প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়।” কিন্তু ‘বংশগতি বিদ্যা’ পড়ে তিনি তাঁর অনাগত সন্তানের জন্য নার্স ঠিক করার ব্যাপারে বেশ অনিচ্ছুক হয়ে উঠেছেন–নীচু শ্রেণির কোন নার্সের দুধ পান করলে অভিজাত শ্রেণির শিশুর রক্তে নীচু ধ্যানধারণা ঢুকে যেতে পারে, এই ভয়ে। সবকিছু মিলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁর স্ত্রী নিজেই সন্তানের দেখাশোনা করবেন, আর কোন কারণে সেটা সম্ভব না হলে, সন্তানকে বোতলের দুধ পান করানো হবে। অবশ্য, গরুর দুধেও আপত্তি নেই; কারণ গরুগুলোকে তো তিনিই খাওয়াচ্ছেন, তিনি খাইয়ে বাঁচিয়ে না রাখলে তো বাছুরগুলো জন্মই নিতে পারত না! সুতরাং, গরুর দুধও গ্রহণযোগ্য।
যথাসময়ে সন্তানের জন্ম হলো–পুত্রসন্তান। ব্যারন সাহেব স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত বেশ চিন্তিত ছিলেন। কারণ, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিজের তেমন কোন সম্পত্তি না থাকলেও, তাঁর স্ত্রী অঢেল সম্পদের মালিক। এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী, তাদের কোন সন্তানাদি না-হওয়া পর্যন্ত, এই সম্পত্তি তিনি দাবি করতে পারবেন না। অতএব, সন্তান হওয়াতে তাঁর আনন্দ সীমাহীন, এবং তা যথেষ্ট যৌক্তিকও বটে! যাহোক, শিশুটিকে দেখে আপাত দৃষ্টিতে নিখুঁত বলেই মনে হচ্ছিল। ওর মোমের মত ত্বকের নীচের নীলাভ শিরা-উপশিরাগুলো চকচক করছিল। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় শিশুর শরীরে রক্তের অভাব। কারণটা অবশ্য ওই রক্তেই নিহিত! ওর মা দেখতে পরীর মত; সেরা-সেরা খাবার খাইয়ে, চারপাশের যাবতীয় খারাপ কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখে, তাঁকে বড় করা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও মুখের ফ্যাকাসে ভাবই বলে দিত। তিনি অভিজাত গোত্রভুক্ত। এবং সঙ্গত কারণেই, তাঁর শরীরে পুষ্টির ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতি এখন তাঁর সন্তানের মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে। যাহোক, ব্যারনের স্ত্রী নিজেই সন্তানের দেখাশোনা করতে লাগলেন। ফলে, সন্তান পালনের জন্য নীচু জাতের কোন মেয়ের কাছে আর ঋণী থাকতে হলো না। ধুর! কে বলেছে নীচু জাতের মায়েরা দুধ না-খাওয়ালে অভিজাত ঘরের শিশুরা বাঁচে না? সব ভুয়া কথা!।
ইদানিং, রাতবিরেতে শিশুর চিৎকার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য, সব শিশুই চিৎকার করে, ওতে খারাপ কিছু বোঝায় না। কিন্তু এখানে বোঝালো। ধীরে ধীরে শিশুর ওজন কমতে থাকল। ভীষণ শুকিয়ে গেল। অগত্যা ডাক্তার ডাকা হল। ডাক্তার এসে শিশুর বাবার সঙ্গে আলাদা বসে কথা বললেন–“যদি আপনার স্ত্রী-ই শিশুকে খাওয়ানোর দায়িত্বে থাকেন, তাহলে নির্ঘাৎ শিশুটি মারা যাবে। কারণ প্রথমত, ব্যারনের স্ত্রী ছিলেন অস্বাভাবিক শুকনো; এবং দ্বিতীয়ত, শিশুকে খাওয়ানোর মত পর্যাপ্ত খাবার তাঁর শরীরে মজুদ ছিল না। ব্যারন সাহেব পড়লেন বিরাট দুর্ভাবনায়। শিশুর কতটুকু দুধ প্রয়োজন, আর কতটা সে পাচ্ছে, তা নিয়ে হিসেবে (রীতিমত গাণিতিক হিসাব!) বসে গেলেন। ফলাফল বেরোলো এই যে, শিশুকে খাওয়ানোর পদ্ধতিগত পরিবর্তন না-আনলে এর মৃত্যু ঠেকানো অসম্ভব।
কী করা যায়?
আর যা-ই হোক, মারা তো যেতে দেয়া যায় না।
“বোতল নাকি নার্স?” দ্বিতীয়টির তো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে, বোতলেই সই! যদিও ডাক্তারের পছন্দ ছিল দ্বিতীয়টি।
হল্যান্ডের সবচাইতে উন্নত জাতের গরুটিকে আলাদা করা হলো। বলা বাহুল্য, এ গরু জেলার সেরা গরু হিসেবে সোনার মেডেলপ্রাপ্ত। সবচেয়ে উন্নত জাতের খাবার খাওয়ানো হতে লাগলো সেটিকে। ডাক্তার এসে দুধ পরীক্ষা করে গেলেন–“সবকিছু একদম ঠিকঠাক।”
বাহ্! কী সহজ সমাধান! ভাবতেই অবাক লাগছে, আগে কেন মাথায় আসেনি!
অতএব, নার্সের ঝামেলা চুকলো। বাচ্চার জন্য নার্স রাখা মানে তো এক স্বৈরাচারীকে ঘরে আনা! সে যেভাবে যা বলবে তা-ই শুনতে হবে। কোথাকার কোন অকর্মার ঢেঁকি! তাকে খাইয়ে-পরিয়ে মোটা বানাতে হবে। আর, তার যদি কোন সংক্রামক রোগবালাই থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
কিন্তু বিধি বাম! শিশুর চিৎকার থামছেই না। সেই সাথে ওজন হ্রাসের চলমানতা। দিন গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে দিন–চিৎকার বিরামহীন। বোঝাই যাচ্ছে, শিশু পেটের অসুখে ভুগছে। তবে উপায়?
নতুন গরু কেনা হলো। নতুন করে দুগ্ধ বিশ্লেষণ। এবারে, দুধের সঙ্গে পানি মিশিয়ে গুণে-মানে কিছুটা পরিবর্তন করা হলেও, শিশুর চিৎকার অপরিবর্তনীয়।
“নার্স নিয়োগ ব্যতীত আরোগ্য অসম্ভব”, ডাক্তারের স্পষ্ট বক্তব্য।
–“ওহ্! এছাড়া কি আর কোনও উপায় নেই? একজন এসে অন্যজনের সন্তানের দায়িত্ব নেবে এটাতো প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ইয়ে, মানে, তাছাড়া, বংশগতির কী হবে? এই জাতীয় নানান কথায় ব্যারন সাহেব যখন প্রকৃতিবিরুদ্ধতা নিয়ে বিরাট ফিরিস্তি দিতে বসেছেন, তখন ডাক্তার তাঁকে থামালেন–“প্রকৃতিকে যদি তার নিজের মত করে চলতে দেয়া হত, তাহলে সমাজে অভিজাত সম্প্রদায় বলে কিছু থাকত না, তাদের সহায়-সম্পত্তি ধূলায় লুটাত। কারণ, অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টিই হয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে।”