—
দারা শুকোহর বিয়ের কয়েক মাস পর আওরঙ্গজেব তার বাবার নজরে পড়ার একটি বিরল সুযোগ লাভ করেন। রাজকীয় প্রিয় বিনোদন হাতির লড়াইয়ের আয়োজন করতে বলেছিলেন শাহ জাহান। সুধাকর ও সুরত সুন্দর (মোগল হাতিদের নাম প্রায়ই হিন্দিতে রাখা হতো) মুখোমুখি হলো। খুব কাছ থেকে লড়াই দেখার জন্য বাদশাহ ও তার তিন বড় ছেলে লড়াই ঘোড়ার পিঠে কাছাকাছিই অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ করেই সুধাকর পাশবিক রোষে আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করে বসে। আওরঙ্গজেব হাতির মাথায় বর্শা বিদ্ধ করেন। এতে হাতিটি আরো ক্ষেপে যায়। সুধাকর তখন আওরঙ্গজেবের ঘোড়াটিতে কাবু করে, ফলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। অন্যরা সাহায্য করার চেষ্টা করেন। সুজা ও রাজা জয় সিং (যথাক্রমে আওরঙ্গজেবের ভাই ও প্রখ্যাত রাজপুত) অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসেন, আতশবাজি নিক্ষেপ করে হাতিকে লক্ষ্যচ্যুত করার চেষ্টা করে প্রহরীরা। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কেবল সুরত সুন্দরই আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে সুধাকরকে ফিরিয়ে আবার লড়াইয়ে মত্ত করতে সক্ষম হয় ।
উল্লেখ্য, এই জীবন-মরণ লড়াইয়ে দারা শুকোহকে কোথাও দেখা যায়নি। এই ঘটনার লিখিত বিবরণে তার ভূমিকার কোনো কথা নেই, আর টিকে থাকা ছবিতে দারাকে পেছনে ওঁত পেতে থাকতে দেখা যায়, তিনি তখন ক্ষতি ও গৌরব উভয় থেকেই নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন।
ফারসি কবিতার মাধ্যমে আওরঙ্গজেবের সাহসিকতা স্মরণীয় করে রেখেছেন শাহ জাহানের রাজকবি আবু তালেব কালিম। তিনি চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন কিভাবে আওরঙ্গজেবের বর্শা বিদ্যুৎ গতিতে সুধাকরের মাথায় আঘাত করেছিলেন। তারপর যুবরাজের বর্শার আঘাতে হাতির মনকে বিষিয়ে পাগল করে দিলো।’ আওরঙ্গজেবের সাহসিকতার প্রশংসা করেন শাহ জাহান, অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও তিনি তার নিজের ছবি দেখেছিলেন তার ছেলের মধ্যে। শাহ জাহানের দরবারি ইতিহাস লেখকেরা একমত হয়ে আওরঙ্গজেবের ভয়হীন এই কৃতিত্বের সাথে ১৬১০ সালে শাহ জাহানের সাথে ক্রুদ্ধ এক সিংহের মোকাবিলার তুলনা করেন। ওই ঘটনা দেখেছিলেন শাহ জাহানের বাবা জাহাঙ্গীর।
—
কয়েক বছর পর সাম্রাজ্য পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য আওরঙ্গজেবকে দরবার থেকে দূরে পাঠিয়ে দেন শাহ জাহান। তখন আওরঙ্গজেবের বয়স মাত্র ১৬ বছর। ১৬৩৫ থেকে ১৬৫৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্য চষে বেড়ান; বলখ, বুন্দেলখন্ড ও কান্দাহারে লড়াই করেন; গুজরাত, মুলতান ও দাক্ষিণাত্য পরিচালনা করেন ।
যুবরাজ এসবের মধ্যেও উপভোগের জন্য সময় বের করে নিতেন, হিরাবাই জৈনাবাদির সাথে ঝড়ো রোমান্সে মেতে ওঠার সময়ও বের করে নিয়েছিলেন। ১৬৫৩ সালে আওরঙ্গজেব বুরহানপুরে তার মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গাছ থেকে আম পাড়ার খেলায় মত্ত হিরাবাইকে দেখে তার প্রেমে বিভোর হয়ে পড়েন। মেয়েটি ছিলেন গায়িকা ও নর্তকী। দুজনে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হন । গুঞ্জন রয়েছে যে আওরঙ্গজেব এই তরুণীর এতটাই অনুগত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি এমনকি সারা জীবনের জন্য মদ্যপান না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (প্রথম ফোঁটা মদ আওরঙ্গজেবের ঠোঁট দিয়ে যাওয়ার আগেই তিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন)। কিন্তু হায়, হিরাবাই এক বছরের কম সময়ের মধ্যে মারা যান, তাকে আওরঙ্গাবাদে সমাহিত করা হয়। এ ধরনের চমকপ্রদ মুহূর্ত সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব তার প্রাপ্তবয়স্ক রাজপুরুষালী আমলে রাষ্ট্রীয় কাজেই বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন।
রাজপরিবার থেকে আওরঙ্গজেবের দূরে থাকাও তাকে তার বাবার হৃদয়কে স্নেহসিক্ত করতে পারেনি। তিনি তার ২২ বছরের এই সময়কালে খুব কমই রাজদরবারে এসেছেন। বিশেষ বিশেষ ঘটনায়, যেমন ১৬৩৭ সালে তার প্রথম বিয়ের সময় এসেছিলেন। প্রশাসনিক ও সামরিক অভিযান- উভয় দিক থেকেই নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করেছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে প্রায়ই দিল্লির সিদ্ধান্তে হতাশ হতেন। দৃশ্যত তার সাফল্য ক্ষুণ্ণ করার জন্যই এমনটা করা হতো। উদহারণ হিসেবে ১৬৫০-এর দশকের ঘটনা বলা যায়। দাক্ষিণাত্যে তার কয়েকটি প্রায় জয়ের মুহূর্তে তাকে বাধ্য করা হয় প্রত্যাহারের জন্য। দারা শুকোহর তাগিদে এই আদেশ জারি করেছিলেন শাহ জাহান ।
আওরঙ্গজেব তার ২০ ও ৩০-এর কোঠার বয়সকালে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করছিলেন, প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছিলেন, দুর্ধর্ষ খ্যাতি অর্জন করছিলেন, তখন দারা শুকোহ রাজদরবারে আয়েসী জীবনযাপন করছিলেন। শাহ জাহানের বড় ছেলে পরিচিত ছিলেন দার্শনিক আগ্রহের জন্য, হিন্দু ও মুসলিম সাধু-সন্ন্যাসীদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় দিন কাটাত তার। কাগজে-কলমে দারা সবসময়ই আওরঙ্গজেবের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বড় ভাই মোগল মনসব ব্যবস্থায় (এতে রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা সম্পৃক্ত ছিলেন) ছিলেন উচ্চতর পদবির অধিকারী। শাহ জাহান তাকেই সিংহাসনে আসীন দেখতে চান বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হতো। কিন্তু দারা কেন্দ্রীয় রাজদরবারের অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের বাইরে থাকা প্রকৃত দুনিয়ার অভিজ্ঞতার অভাবে ছিলেন। আর এটিই পরে মারাত্মক অসুবিধা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল ।
লোকরঞ্জক স্মৃতিতে প্রায়ই দারা শুকোহর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়, ভারতীয় ইতিহাসের বড় ‘কী হতো যদি’ বিবেচনা করা হয় তাকে। ‘ধর্মান্ধ’ আওরঙ্গজেবের বদলে ষষ্ট মোগল বাদশাহ যদি হতেন ‘উদার’ দারা, তবে কী হতো? ইতিহাস কি ভিন্ন দিকে মোড় নিত? সাম্প্রতিক সময়েও অনেকে শহিদ নাদিমের দারা নাটকে উদ্দীপ্ত হয়ে প্রশ্ন করেন, বাদশাহ হলে কি দারা ১৯৪৭ সালের ভারতবর্ষের নৃশংস বিভক্তি অনেক আগেই নাকচ করতে পারতেন? অযাচিত নস্টালজিয়া সরিয়ে রাখা রেখে বলা যায়, বাস্তবতা হলো এই যে জয়ী হতে বা মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না দারার। হিন্দুস্তানের মুকুটের জন্য চার ভাইয়ের মধ্যকার অনিবার্য মোকাবিলায় দারার অসুস্থ বাদশাহকে সাথে রাখাটা আওরঙ্গজেবের জোট, কৌশলগত দক্ষতা, 3 মোগল সাম্রাজ্য কয়েক দশক ধরে ঘুরে ঘুরে যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা অর্জন করেছিলেন, তার সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো ছিল না ।
বিশ্ব জয় করলেন আওরঙ্গজেব
ইয়া তখত ইয়া তাঁবুত
হয় সিংহাসন নয়তো কবর
–মোগল রাজত্বের একটি মন্ত্র