এই পার্থক্যের- রক্ষণাত্মকভাবে চিন্তা করা বনাম ঐতিহাসিকভাবে চিন্তা করা- একটি ভালো উদাহরণ হলো হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ। লোকরঞ্জক ধারণায় আওরঙ্গজেবকে সব হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ও সবভাবে তাদেরকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন বলে কল্পনা করা হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ইতিহাসবিদ বিজ্ঞচিতভাবে বলতে পারেন যে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে আওরঙ্গজেব সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে হিন্দুদের সাথে আচরণ করেছিলেন। মোগল রাষ্ট্র ও বিশেষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায়ই সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হতো এবং এতে অনেক সময় স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়ও থাকত। কিন্তু অনেক হিন্দুই আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে সহিষ্ণুতা ও সুরক্ষা লাভ করেছিল। আওরঙ্গজেবের শাসন নিয়ে চিন্তা করার সময় নির্ভুল হলেও এ ঐতিহাসিক সংশোধনটি হিন্দুদের ব্যাপারে সাধারণ কোনো ধারা গ্রহণ ফলপ্রসূ পথ কিনা সেই মৌলিক প্রশ্নটি বিবেচনা করতে পারেনি।
বাস্তবে আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে হিন্দুদের ব্যাপারে সার্বজনীন কোনো এজেন্ডা অনুসরণ করেননি। ওই আমলে ‘হিন্দুরা’ সাধারণত নিজেদের ওই পরিভাষায় পরিচিত করত না, তারা বরং আঞ্চলিক, সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী পরিচয়ে (যেমন রাজপুত, মারাঠা, ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব ইত্যাদি) পরিচিত করত। অনেক বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন, ‘হিন্দু’ শব্দটি সংস্কৃত নয়, বরং ফারসি। আর এ শব্দটি ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে সাধারণভাবে স্ব-উল্লেখে ব্যবহৃত হয়েছিল । মোগলরাও ‘হিন্দুদের’ বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যকার পার্থক্যকে গুরুত্ব দিত। উদাহরণ হিসেবে মোহাব্বত খানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ১৬৭০-এর দশকে অল্প সময়ের জন্য দাক্ষিণাত্যে মোগল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি এমনকি মারাঠাদের (তারা দৃশ্যত এই ঘটনায় ‘হিন্দু’ হিসেবে বিবেচিত হয়নি) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় মোগল আভিজাত্যের মধ্যে ‘রাজপুত ও হিন্দুদের’ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আওরঙ্গজেবের আমলে একটি ব্লক হিসেবে মোগল-হিন্দু সম্পর্ককে মূল্যায়ন করার বদলে আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তথা বিশেষ গ্রুপ ও পদক্ষেপকে আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করব। এর ফলে পাঠকেরা এখানে হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ নিয়ে আলাদা কোনো অংশের দেখা পাবে না, বরং মোগল রাষ্ট্রের পক্ষে নিয়োজিত হিন্দু অভিজাত, ব্রাহ্মণ নেতা এবং সশস্ত্র মারাঠা বিরোধিতারীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা দেখতে পাবে!
আমাদের সময়ের সীমাবদ্ধকরণ, সাম্প্রদায়িক পরিভাষার ঊর্ধ্বে আমরা যদি ওঠতে পারি, এবং এর বদলে সপ্তদশ শতকের মোগল বিশ্বকে পুনরুদ্ধারের প্রবল প্রয়াস চালাই, তবে আওরঙ্গজেবের এক চমকপ্রদ ছবির আবির্ভাব ঘটবে। এই আওরঙ্গজেব ছিলেন ভারতবর্ষের সম্রাট। তিনি সারা জীবন সাধনা করেছেন মোগল সাম্রাজ্য রক্ষা ও সম্প্রসারিত করার, রাজনৈতিক শক্তি লাভ করার এবং ন্যায়বিচারবিষয়ক তার নিজস্ব ধারণার আলোকে শাসন করার ।
—
আওরঙ্গজেবের জীবন সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্যের ব্যাপারে ইতিহাসবিদেরা একমত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৬১৮ সালের শরতে। ১৬৫৮ সালে ৩৯ বছর বয়সে তার প্রথম রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। তিনি ১৬৮১ সালে পুরো রাজদরবার নিয়ে দাক্ষিণাত্য অভিযানে বের হয়েছিলেন। ওই সময় তার বয়স ছিল ৬০-এর কোঠার মাঝামাঝিতে। এরপর তিনি বিজাপুর, গোলকোন্ডা ও এমনকি তামিল নাড়ুর অংশবিশেষও জয় করেছিলেন। তিনি ৮৮ বছর বয়সে ১৭০৭ সালে পরলোকগমন করেন । তবে আমরা তথ্যগুলোকে কিভাবে একসাথে করে সাজাব, তার আলোকে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আকর্ষণীয় সবকিছু বের হয়ে আসে। অন্য কথায় বলা যায়, আর এই ভাষ্যই আসল জিনিস ।
আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্য একইসাথে সম্রাট হিসেবে তার জীবনে গভীরতা ও ব্যাপকতা অনুসন্ধান করেছে। এগুলো কিছুটা কালক্রমানুনিকভাবে ও কিছুটা বিষয়ভিত্তিক সাজানো হয়েছে। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের জীবনকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা মোগল রাজত্ব, নৈতিক আচরণ, রাজনীতি সম্পর্কে তার ধারণা গঠনকারী প্রধান শক্তিগুলো উপলব্ধি করতে পারি, সময়ের পরিক্রমায় এসব শক্তি কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তাও দেখতে পাই। সিংহাসনে থাকাকালীন কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমরা আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আরো গভীর মূল্যায়ন ও তার ঐতিহাসিক নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানতে পারি ।
আমি আওরঙ্গজেবের জীবনের প্রথম চার দশক তথা তার তারুণ্য আমল দিয়ে শুরু করব। এ সময়ই তিনি বিশেষ করে ভাইদের বিরুদ্ধে আসন্ন উত্তরাধিকার লড়াইয়ে বিপুলভাবে জয়ী হওয়ার অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন। দুই বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর আওরঙ্গজেব সিংহাসন নিশ্চিত করেন, অল্প সময়ের মধ্যেই তার নিজের প্রয়োজনের (তার প্রায় ৫০ বছরের শাসনকালে প্রকাশিত প্রকল্প) সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্ষমতাসীন সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেন। আওরঙ্গজেবের শাসনের তিনটি বিষয় তার শাসন কৌশল ও ন্যায়বিচার-সম্পর্কিত ধারণা পেতে আমাদের সহায়তা করে। এগুলো হচ্ছে : সাম্রাজ্যিক আমলাতন্ত্র, একজন নৈতিক নেতা হিসেবে আওরঙ্গজেবের নিজেকে মূল্যায়ন এবং হিন্দু ও জৈন মন্দির সম্পর্কে তার নীতি। এগুলো আওরঙ্গজেবের শাসনকালের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত এবং স্বল্প জানা ঘটনাগুলো সামনে নিয়ে আসে। সর্বোপরি, এসব অধ্যায় প্রায়ই একটিমাত্র চশমা দিয়ে দিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত একজন বাদশাহ-সম্পর্কে ঐতিহাসিক গভীরতা যোগ করে। আমি এর পর আওরঙ্গজেবের জীবনের শেষ দিকের বর্ণনা দেব। এসবের মধ্যে রয়েছে দাক্ষিণাত্যে তার শেষ দশকগুলোর সংগ্রাম ও মৃত্যু। অষ্টাদশ শতকে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তাকে যেসব কারণে অভিযুক্ত করা হয়, সেগুলোর ওপরও আমি আলোকপাত করব।