তবে কোনোভাবেই কেউ বলবে না যে আওরঙ্গজেব ত্রুটিহীন ছিলেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক, সার্বজনীন মূল্যবোধ ও মানবাধিকার মানদণ্ড পূরণ করতে না-পারা আওরঙ্গজেবের অনেক পদক্ষেপ খুঁজে বের করা কঠিন নয়। রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের প্রাক-আধুনিক বিশ্বে শাসনকাজ পরিচালনা করেছিলেন আওরঙ্গজেব। সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও অন্য সবকিছুই ওই সময় ও তিনি যে স্থানে বাস করেছিলেন তার সাথে শর্তসাপেক্ষ। আওরঙ্গজেবের সমসাময়িকদের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লস, ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই, উসমানিয়া সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় সোলায়মান। কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না যে এসব ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বর্তমান সময়ের রীতিনীতি অনুযায়ী ‘সুশাসক’ ছিলেন। কারণ অতীতকে বর্তমানের মানদণ্ডের সাথে তুলনা করার কোনো মানে হয় না । ঐতিহাসিক সমীক্ষার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু ।
ইতিহাসবিদেরা বিশেষ সময় ও স্থানের ফসল হিসেবে তাদের নিজস্ব অবস্থার আলোকে ওই ব্যক্তিদের উপলব্ধি করতে চান, তাদের কর্মপন্থা ও প্রভাবের ব্যাখ্যা করেন। যাদের নিয়ে আমরা সমীক্ষা চালাচ্ছি, তাদেরকে অপরাধ মুক্ত করার কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই এবং তাদেরকে পছন্দ করার কোনো দরকারও নেই আমাদের। তবে আমরা অভিমত প্রকাশ করা থেকে যথেষ্ট সময় বিরত থাকার চেষ্টা করেছি এ কারণে যে যাতে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে থাকা কল্পকথা আড়ালে ম্লান হয়ে যায় এবং আরো বোধগম্য ও বিশ্বাসযোগ্য কথা বলার অবকাশ সৃষ্টি হয় ।
মানুষ আওরঙ্গজেবকে ফিরে পাওয়া
সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তির স্থিতিশীলতা নির্ভর করে ন্যায়বিচারের (আদালত) ওপর।
–শাসকদের সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ বাণী, আওরঙ্গজেবের সমর্থিত
হিন্দুস্তানের শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেব তার জীবনকে বিন্যস্ত করেছিলেন কিছু প্রধান আদর্শ ও বদ্ধমূল ধারণার আলোকে। তিনি হতে চেয়েছিলেন ন্যায়পরায়ণ রাজা, ভালো মুসলিম, মোগল সংস্কৃতি ও প্রথা রক্ষাকারী। আওরঙ্গজেব একইসাথে একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রেরও প্রধান ছিলেন, প্রায়ই সহিংসতা প্রয়োগ করে উপমহাদেশ ও এর অধিবাসীদের ওপর রাজকীয় কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ করার প্রয়াস চালাতেন। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্যটি সর্বোপরি ন্যায়বিচারসহ এসব সার মূল্যবোধ অনুসরণে তার চেষ্টা, এবং রূঢ় ক্ষমতা কব্জা করার জন্য যেসব আদর্শ তিনি বিসর্জন দিয়েছেন, সেইসব উদাহরণ কেন্দ্র করে প্রণীত 1
ন্যায়বিচার সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের ভাষ্য বৃহত্তর ইসলামি ঐতিহ্যের রঙে গভীরভাবে রঞ্জিত, এর বেশির ভাগের সাথে ধর্মতত্ত্বের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই । ন্যায়বিচার-সম্পর্কিত প্রাক-আধুনিক ‘ইসলামি’ আদর্শ ব্যাপকভাবেই ইসলাম পূর্ববর্তী পারস্য ও গ্রিক দর্শন থেকে গৃহীত। এই ভাষ্যে জিহাদ ও জিজিয়ার (যথাক্রমে ধর্মযুদ্ধ ও ব্যক্তির ওপর আরোপিত কর) মতো বিভেদকারী ধারণাগুলো আখলাক ও আদবের (যথাক্রমে রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিক মূল্যবোধ) মতো আদর্শগত ধারণার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। আওরঙ্গজেব তার রাজকীয় পূর্বসূরীদের মাধ্যমেও প্রভাবিত হয়েছিলেন, নিজেকে পূর্ববর্তী মোগল রাজাদের অনুকরণে গড়ে তুলেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ন্যায়বিচার-সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের আদর্শ বর্তমান সময়ে সাধারণভাবে গৃহীত আদর্শের সাথে মেলে না। কিন্তু তা খুব বড় বিষয় নয়। সমসাময়িক মানদণ্ডে আওরঙ্গজেবকে বিচার করার বদলে আমি চেয়েছি তার জীবন ও শাসন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভাষ্য নির্মাণ করতে এবং কয়েক শ’ বছর ধরে আমাদের মেনে নেওয়া ভুল তথ্যের নিচে চাপা পড়ে থাকা এই ব্যক্তি ও রাজাকে উদ্ধার করতে।
ন্যায়বিচার, ধর্মানুরাগ ও মোগল রাষ্ট্রের প্রতি আওরঙ্গজেবের ভক্তি ফারসি ইতিহাস গ্রন্থরাজি, বাদশাহর চিঠিপত্র ও সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকজুড়ে থাকা অন্য প্রাথমিক দলিল-দস্তাবেজগুলোতে বারবার উল্লেখ করা বিষয়। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্যের মূল কাঠামো এসেছে এসব ফারসি রচনাবলীর সমালোচনামূলক পাঠ থেকে। এছাড়াও হিন্দি, সংস্কৃত, ও অন্যান্য ভাষায় (আরো জানার জন্য এই বইয়ের শেষ দিকে থাকা জীবনীমূলক প্রবন্ধ ও পুনশ্চ : মধ্য যুগের ফারসি সাহিত্য পাঠ নিয়ে নোট অধ্যায় দেখুন) গবেষণাও রয়েছে। আওরঙ্গজেবের আদর্শগুলো- বিশেষ করে তার ন্যায়বিচার, মূল্যবোধ ও যথার্থ ইসলামি আচরণবিষয়ক ধারণাগুলো- বর্তমানে এগুলো সাধারণভাবে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তা থেকে অনেক ভিন্ন। তবে তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন কিনা তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং আমি জানতে চাই, আওরঙ্গজেব ন্যায়পরায়ণ শাসক বলতে কী বুঝতেন এবং তা কিভাবে হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে তার বিশ্ব-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থা গড়ে দিয়েছিল ।
বোধগম্যভাবেই আওরঙ্গজেব তার নিজস্ব পরিভাষাতেই একটি প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগ, তবে বর্তমান সময় পর্যন্ত তা করার চেষ্টা হয়েছে সামান্যই। এই বই মধ্য যুগের ভারতবর্ষে আওরঙ্গজেবের প্রভাব এবং ইন্দো মুসলিম ইতিহাসের মধ্যে তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি আরো ভালোভাবে বুঝতে আমাদের সহায়তা করবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জোরালো বাস্তব ঐতিহাসিক বক্তব্য বর্তমানের (যা আওরঙ্গজেবকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যা তিনি কখনোই ছিলেন না) আবেগকে প্রশমিত করতে পারে। এটিও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক যে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বর্তমান বিকৃতির মধ্যে আমার সুপারিশ করা মধ্যবর্তী ভূমিকার ভিত্তি চিন্তাশীল ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। এর বিপরীতে, আগেকার চিন্তাবিদেরা আওরঙ্গবের উত্তপ্ত লোকরঞ্জক ভাবমূর্তি প্রশমিত করতে দুটি ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু রক্ষণাত্মক হওয়ায় উভয়টিই ব্যর্থ