আওরঙ্গজেবের বক্তব্য ফরমান (রাজকীয় আদেশ) আকারে এবং সেগুলোর রাজোচিত সমান্তরাল নিশান আকারেও আমাদের কাছে এসেছে। আমি হিন্দু মন্দির ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বিশেষভাবে নির্ভর করেছি জ্ঞান চন্দ্রের আওরঙ্গজেবের ফরমানবিষয়ক প্রবন্ধগুলোর ওপর। এ ব্যাপারে এস এ আই তিরমিজির মোগল ডকুমেন্টস (দিল্লি, ১৯৯৫)-এর ওপর নজর বুলিয়েছি।
আওরঙ্গজেবের আমলের সংবাদ প্রতিবেদনগুলো (আখবারাত) এখনো অনেক আর্কাইভে টিকে আছে। অবশ্য এই গ্রন্থে সেগুলোর সীমিত ব্যবহার হয়েছে। আমি অন্যান্য বিশেষজ্ঞের প্রতিবেদনের মাধ্যমেই সেগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মনিষ ফারুকি তার প্রিন্সেস অব দি মোগল এম্পায়ারে (ক্যাম্ব্রিজ, ২০১২) আখবারাত-ই দারবার-ই মাওলা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। এটি আছে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়ায় ৷
—
আওরঙ্গজেবের ওপর মাধ্যমিক সাহিত্য বিপুল, তবে যতটা ধারণা করা যেতে পারে, তার চেয়েও ভাসা ভাসা। ঊনিশ শতকে মন্টস্টুয়ার্ট ইলফিনস্টোন (১৮৪১) ও স্ট্যানলি লেন-পুলের (১৮৯৩) রচিত আওরঙ্গজেবের জীবনী ছাপা থাকলেও তা সেকেলে হয়ে পড়েছে। আমি এখানে এ জাতীয় গ্রন্থের ওপর নির্ভর করিনি। আত্ম-প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮) বিশ শতকে আওরঙ্গজেবের ওপর সবচেয়ে বেশি গবেষণামূলক কাজ করেছেন । তিনি আওরঙ্গজেবের আমলের অনেক ইতিহাস ও চিঠিপত্র সঙ্কলন ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, আওরঙ্গজেবের ওপর অনেক বই প্রকাশ করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে অমূল্য পাঁচ খণ্ডের হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব (১৯১২-২৪)। দীর্ঘ সময় ধরে তিনিই ছিলেন আওরঙ্গজেবের ওপর শেষ কথা। যদুনাথ সরকারের সর্বাত্মক প্রয়াসের পরের কয়েক দশকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম সংখ্যক বিশেষজ্ঞ এই বাদশাহকে নিয়ে লিখেছেন। বিশেষজ্ঞরা ধীরে ধীরে আওরঙ্গজেবকে অধ্যায়নে ফিরে গেছেন, যদুনাথ সরকার যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তারা বাদশাহকে দেখতে পেয়েছেন ভিন্নভাবে। আমরা সবাই যদুনাথ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ হলেও তার বিশ্লেষণ ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ এবং অনেক সময় তাতে ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতার অভাব দেখা যায়। যারা যদুনাথ সরকারের পদ্ধতি ও কৃতিত্ব নিয়ে চিন্তা করতে চান, তাদের উচিত হবে দিপেশ চক্রবর্তীর দি কলিং অব হিস্টরি : স্যার যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিস এম্পায়ার অব ট্রুথ (শিকাগো, ২০১৫) বিবেচনা করা।
আরো সাম্প্রতিক সময়ে আওরঙ্গজেবের ওপর গবেষণা বেড়েছে, আমি এই রচনায় তা গ্রহণ করেছি। আমি ওপরে যেসব বিশেষজ্ঞের নাম উল্লেখ করেছি, তার বাইরে নিম্নোক্তদের লেখা ছিল বিশেষভাবে ফলপ্রসূ : এম আতাহার আলী, সতীশ চন্দ্র, এস এম আজিজুদ্দিন হোসাইন, ইরফান হাবিব, হারবান্স মুখিয়া ও জন রিচার্ডস। আরো অনেক বিশেষজ্ঞ আওরঙ্গজেবের শাসকালের বিশেষ বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন। আমার লেখায় তাদের তথ্য ব্যবহার করেছি। এসবের মধ্যে রয়েছেন : ক্যাথেরিন অ্যাশর (স্থাপত্য), রিচার্ড ইটন (মন্দির অবমাননা),
লুই ফেঞ্চ (শিখদের সাথে সম্পর্ক), ইউহানান ফ্রিডম্যান (সরহিন্দি নিষিদ্ধকরণ), যশ গোম্যান্স (যুদ্ধ ও দাক্ষিণাত্যের বছরগুলো), স্টুয়ার্ট গর্ডন (মোগল-মারাঠা সঙ্ঘাত), বি এন গোস্বামী (হিন্দু সন্ন্যাসী), জে এস গ্রেওয়াল (ফতোয়া-ই আলমগিরি), রবার্ট হ্যাঁলিসে (রাজপুতদের সাথে সম্পর্ক), শালিন জৈন (জৈনদের সাথে সম্পর্ক), হেইদি পাওয়েলস (কেশব দেব মন্দির), ক্যাথেরিন বাটলার স্কোফিল্ড (নি ব্রাউন, সঙ্গীত) ও তাইমিয়া জামান (ভীমসেন স্যাক্সেনা)। বিনয় লালের ওয়েবসাইটটি (Manas; http://www.sscnet.wcla.edu/southasia/) আওরঙ্গজেবের শাসনকালের বেশির ভাগ বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত, সহজবোধ্য প্রবন্ধ রয়েছে। মোগল ইতিহাসের বেশ কিছু পর্যালোচনায় বৃহত্তর মোগল প্রকল্পে আওরঙ্গজেবের খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি দেখানো হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে মাইকেল এইচ ফিশার, অ্যা শর্ট হিস্টরি অব দি মোগল এম্পায়ার (লন্ডন, ২০১৬), জন এফ রিচার্ডস, দি মোগল এম্পায়ার (ক্যাম্ব্রিজ, ১৯৯৩), ফ্রান্সিস রবিনসন, দি মোগল এম্পেস অ্যান্ড দি ইসলামিক ডাইনাস্টিকস অব ইন্ডিয়া, ইরান অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়া, ১২০৬-১৯২৫ (নিউ ইয়র্ক, ২০০৭)।
এ বইটি লেখার সময় সুপ্রিয়া গান্ধী (দারা শুকোহ), ইয়াল রাইস (পেইন্টিং) ও বেশ কয়েকজন সহকর্মীর অপ্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে সহায়তা গ্রহণ করার সুবিধা পেয়েছি। এছাড়া সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ২০১৪ ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর সাউথ-এশিয়ান স্টাডিজ কনফারেন্সে হেইদি পাওয়েলসের আয়োজিত আওরঙ্গজেববিষয়ক প্যানেলের অনেক লেখকের রচনাও দেখেছি। বর্তমান সময়ে আওরঙ্গজেব একটি নতুন করে সৃষ্টি হওয়া ব্যাপক আগ্রহের বিষয়। অনেক বিশেষজ্ঞ শিগগিরই তার ওপর অনেক মাধ্যমিক পর্যায়ের সামগ্রী উপহার দিতে চলেছেন ।
—
আওরঙ্গজেববিষয়ক নথিপত্রের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়ে বলা শেষ দুটি কথা হলো যথাক্রমে প্রাচুর্যতা ও স্বল্পতা। আওরঙ্গজেব ইতোমধ্যেই সম্ভবত সবচেয়ে প্রামাণিক মোগল সম্রাটে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আখবারাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথিপত্রে প্রবেশগম্যতা গবেষকদের জন্য কঠিন। তাছাড়া আওরঙ্গজেববিষয়ক নতুন নতুন সামগ্রী নিয়মিত আত্মপ্রকাশ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্রাটের একটি তরবারি ২০১১ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাবার্ড থেকে চাঞ্চল্যকরভাবে বের হয়েছে। বেসরকারি বাজারে প্ৰামাণিক সামগ্রী আত্মপ্রকাশ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৪ সালে ক্রিস্টিসে আওরঙ্গজেবের ইস্যু করা একটি ফরমান ২৭,৫০০ পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে। আওরঙ্গজেবের ওপর যারা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে চান, তাদের নথিপত্রের অভাবে ভুগতে হবে না ।