আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কয়েক দশকের মধ্যে লেখকেরা অনেক ইতিহাস রচনা করেছেন। কাফি খানের মুন্তাখাব আল-লুবাব (আনুমানিক ১৭৩০) ও সাকি মুস্তাইদ খানের মাইসির-ই আলমগির (১৭১০) অনেক ইতিহাসবিদের কাছে খুবই প্রিয়। এর আংশিক কারণ বই দুটির মইনুল হক (করাচি ১৯৭৫) ও যদুনাথ সরকারের (কলকাতা, ১৯৪৭) ইংরেজি সংস্করণ পাওয়া যায়। এছাড়া বই দুটিতে আওরঙ্গজেবের পুরো আমলের তথ্য থাকার কারণেও জনপ্রিয় পরবর্তীকালে লেখা হওয়ায় এবং আওরঙ্গজেবের নীতিপরায়ণ প্রকাশ্য ভাবমূর্তির ওপর জোর দেওয়া বাগাড়ম্বড়াতার কারণে বই দুটির ব্যাপারে আমি একদিকে যেমন সতর্ককতা অবলম্বন করেছি, অন্য দিকে অন্যান্য সূত্রের সাথে তুলনা করেছি। আমি কাফি খানের ইলিয়ট ও ডাওসনের অনুবাদের সাথে ভিন্ন মত প্রকাশ করছি। জনপ্রিয়তার কারণে আমি যদুনাথ সরকারের মাইসির-ই আলমগিরির অনুবাদের কথা উল্লেখ করেছি। তবে পাঠকদের সতর্ক থাকতে হবে যে যদুনাথের অনুবাদটি অসম্পূর্ণ, এতে ভুল রয়েছে (এই অনুবাদ নিয়ে আরো কিছু তথ্যের জন্য টিলম্যান কুলকের ‘অ্যা মোগল মুনসি অ্যাট ওয়ার্ক’ ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট, পিএইচডি থিসিস, ২০১৬], ১০-১৫, ২০-২২ দেখা যেতে পারে)।
ভীমসেন স্যাক্সেনার তারিখ-ই দিলখুশা দাক্ষিণাত্যের ঘটনাবলীর একটি অমূল্য ভাষ্য। আমি একটি ব্রিটিশ লাইব্রেরি পাণ্ডুলিপির (অর, ২৩) সাথে যদুনাথ সরকারের অনুবাদ তুলনা করেছি এবং কয়েকটি পৃষ্ঠার পুনঃঅনুবাদ করেছি। নগর ব্রাহ্মণ ও যোধপুরের মোগল বেসামরিক কর্মকর্তা ঈশ্বরদাস লিখেছেন ফুতুহাত-ই আলমগিরি, আনুমানিক ১৭০০ সালে (যদুনাথ সরকার ভুল করে সালটি উল্লেখ করেছেন ১৭৩০)। ফুতুহাতে (ভাদোদারা, ১৯৯৫) নিশ্চিতভাবেই কিছু ঐতিহাসিক ভুল আছে, তবে তা সত্ত্বেও এমন কিছু বিবরণ আছে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। স্বল্প ব্যবহৃত মিরাত-ই-আহমদি (১৭৫৪) গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের গুজরাত আমলের কথা বলা হয়েছে। শাহ নওয়াজ খানের মাইসির আল-উমারা, সম্পাদনা আবদুর রাহিম ও মির্জা আশরাফ আলী (কলকাতা, ১৮৮৮-৯১), ১৭৮০ সাল পর্যন্ত মোগল অভিজাতদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত দেয়। এছাড়া রয়েছে এইচ বেভারিজ ও বেনী প্রাসাদ (পাটনা, ১৯৭৯) অনূদিত মাইসির আল-উমারাও।
ফারসি ভাষার ইতিহাস ছাড়াও আমি ভূষণের শিবরাজভূষণের (অনুবাদের জন্য অ্যালিসন বাচকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি) মতো বইগুলোসহ সীমিত পরিসরে হিন্দি সাহিত্য ব্যবহার করেছি। আমি জ্ঞান চন্দ্রের সহযোগিতায় জৈন ভাষায় লিখিত বই দেখিছি (এই বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো মোহাম্মদ আকরাম লারি আজাদের রিলিজিয়ন অ্যান্ড পলিটিক্স ইন ইন্ডিয়া (দিল্লি, ১৯৯০], ২৩৪-৩৭)। আমি সহায়তার মাধ্যমে শিখ সামগ্রীও কিছুটা ব্যবহার করেছি। আওরঙ্গজেবের জীবনের আরো ব্যাপকভিত্তিক জীবনী রচনার জন্য অন্যান্য হিন্দি গ্রন্থ বিশেষ করে রাজপুত দরবারের গ্রন্থগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া লক্ষ্মীপতির অবদুল্লাকরিত ও নৃপতিনিতিগরবিতাভৃত্তের মতো সংস্কৃত সামগ্রীর সহায়তাও গ্রহণ করা যায়। এগুলোতে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাগুলো রয়েছে ।
ইতিহাসবিদদের জন্য ইউরোপিয়ান ভ্রমণকাহিনীগুলো আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষ সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই নির্ভরযোগ্য উৎস। বিশেষ করে নিকোলাও মানুচির স্টোরিয়া ডি মোগর, (অনুবাদ উইলিয়াম আরভিন, লন্ডন, ১৯০৭-০৮), ফ্রাসোয়া বার্নিয়ারের ট্রাভেলস ইন দি মোগল আম্পায়ার (অনুবাদ আর্চিবল্ড কনস্টাবল ও ভিনসেন্ট স্মিথ, অক্সফোর্ড, ১৯১৪) ও জ্যা-বাস্তাইজ টাভারনিয়ারের ভয়েজ (অনুবাদ ভি. বল, লন্ডন, ১৮৮৯)-এর কথা বিশেষভাবে বলা যেতে পারে। এখানে আমি জেমেলি ক্যারেরি, পিটার মুন্ডি, উইলিয়াম নরিস, জন অভিঙ্গটন ও জ্যা ডি থেভেনটের মতো কিছুটা কম জনপ্রিয় ভাষ্যের উদ্ধৃতি দিয়েছি। বিদেশী পর্যটকেরা মোগলদের নিয়ে বড় ধরনের অন্তঃদৃষ্টি তুলে ধরেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই কোনো কারণ ছাড়াই ভারতীয় নথিপত্রের চেয়ে ইউরোপিয়ান গ্রন্থগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা কিভাবে কল্পকাহিনী ও বাস্তবতার মধ্যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছেন তা না বুঝেই
—
আমি আওরঙ্গজেবের চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাকেই তার সম্পর্কে কিছুটা বলার সুযোগ দিয়েছি। এসব চিঠিপত্র ওই সময়ের অনেক মোগল ইতিহাসে তাকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে সেই ছবির চেয়ে ভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে তাকে উপস্থাপন করে। আওরঙ্গজেব অনেক চিঠি লিখেছিলেন ফারসি ভাষাতে, সম্ভবত দুই হাজার এখনো টিকে আছে। এগুলো নিয়ে বেশ কয়েকটি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আদব-ই আলমগিরি, কালিমাত-ই তাইবিয়াত, রাকাইম-ই কারিম ও রুকাত-ই আলমগিরি (আমি ব্যাপকভাবে বিলিমোরিয়ার ইংরেজি অনুবাদ ব্যবহার করেছি, তবে মূল ফারসি ভাষার কাছাকাছি ভাষ্যই প্রয়োগ করেছি। আমি দস্তার আল-আমল আগাহি ও আহকামই-আলমগিরির (এটি আর যদুনাথ সরকারের অ্যানিকডোটেস অব আওরঙ্গজেব নামে প্রকাশিত গ্রন্থটি এক নয়) মতো অপ্রকাশিত সঙ্কলন ব্যবহার করিনি। যদুনাথ সরকারের অ্যানিকডোটেস (কলকাতা, ১৯১৭) প্রলুব্ধ সৃষ্টিকারী গ্রন্থ, এতে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে টুকরা টুকরা অনেক রসাল কাহিনী আছে। এতে অবশ্য অনেক ভুল তথ্যও রয়েছে। যদুনাথ সরকারও তা স্বীকার করেছেন, কিছু কিছু পাদটীকায় কয়েকটি ঘটনার সত্য ভাষ্যও উল্লেখ করেছেন। আমি যদুনাথ সরকারের অ্যানিকডোটেস সতর্কতার সাথে ব্যবহার করেছি, আওরঙ্গজেবের কথিত দ্বিতীয় উইল (দেখুন, অ্যানিডোটেস, ৫১-৫৫) এবং এ জাতীয় অনেক সম্ভাব্য বানোয়াট ভাষ্য পুরোপুরি বাদ দিয়েছি।