এমনকি বিশেষজ্ঞরা আওরঙ্গজেব আমলের নথিপত্র দেখার ও পাঠের যদি সুযোগ পানও তখন বড় ধরনের বাধা হিসেবে সামনে আসে এসবের ব্যাখ্যা। কাফি খান (মুন্তাখাব আল-লুবাব) ও মুসতাইদ খানের (মাসির-ই আলমগির মতো আওরঙ্গজেব শাসনকালবিষয়ক তথাকথিত প্রধান প্রধান ইতিহাসবিদের অনেকে লিখেছেন আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর অনেক পরে এবং তারা কয়েক দশক আগে সংঘটিত ঘটনাগুলো পুনঃগঠনের জন্য স্মৃতিকথা ও জনশ্রুতির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছেন। এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে অগোচরে অনিচ্ছাকৃত ভুল তাদের রচনায় প্রবেশ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যের সন্ধান পাওয়া গেলে এসব গ্রন্থকে তুলনা করে ভুলগুলো শনাক্ত করা যায়। এমনকি রাজাদেশ ও চিঠিপত্রসহ যেসব নথিপত্র অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়, সেগুলোও প্রায়ই ঘটনাটি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর চিত্র সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক নির্দেশ কখনো কার্যকর করা হয়নি ।
অধিকন্তু, মধ্য যুগের অনেক লেখক যথার্থ তথ্য প্রাপ্তি নিয়ে আচ্ছন্নতায় থাকতেন না। বরং এর বিপরীতে আওরঙ্গজেবের আমলে ইতিহাসবিদদের মধ্যে আদর্শ কৌশল ছিল অতীতকে ভ্রমাত্মকভাবে উপস্থাপন করা। এসব ইতিহাসবিদ তারিখ (ফারসি ঘরানার ইতিহাস রচনা) লেখার সময় অতীতকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরার মতোই বাধিত থাকতেন সাহিত্যিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য। সাহিত্যিক প্রয়োজনের আলোকে ইতিহাস পরিবর্তন করা ছাড়াও কাফি খানের মতো লেখকেরা ব্যাপক বাগাড়ম্বড়তার আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের এ কৌশল আমাদেরকে তাদের পক্ষপাতিত্বের কথা প্রকাশ করলেও বিশেষ রাজকীয় সিদ্ধান্তটি গ্রহণের নেপথ্য কারণটি অন্ধকারে রেখে দিয়েছেন। অবশ্য এ ধরনের স্তরে স্তরে থাকা অংশগুলো প্রাক-আধুনিক ঐতিহাসিক ভাষ্যগুলোকে বাতিল করে দেয় না। তবে মোগল ইতিহাস দায়িত্বশীলতার সাথে পুনঃনির্মাণের জন্য আমাদেরকে এসব তথ্যের সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক উভয় মান বিচার করে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে ।
বেশির ভাগ আধুনিক ইতিহাসবিদ ফারসি-মাধ্যমের মোগল ইতিহাসের সাথে ইউরোপিয়ান ভ্রমণকাহিনী, হিন্দি ও অন্যান্য স্থানীয় ভাষার রচনাবলী ও (সাধারণভাবে সবচেয়ে কম) সংস্কৃত গ্রন্থরাজিসহ অন্যান্য ভাষার প্রাক-আধুনিক গ্রন্থরাজিকে পরিপূরক হিসেবে গ্রহণ করেন। এসব গ্রন্থে প্রায়ই কল্পনা ও বাস্তবতার মিশ্রণ দেখা যাওয়ায় এগুলোও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। ইউরোপিয়ান ভ্রমণকাহিনীগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ লাভ করে, কারণ মোগল সাম্রাজ্যবিষয়ক অনেক বিশেষজ্ঞ এখনো বুঝতে পারছেন না এসব রচনা আসলে বাস্তব তথ্যের সাদাসিধে বর্ণনা নয়, বরং এগুলো বিশেষ শ্রেণির পাঠকদের (এবং প্রায়ই পুঁজিবাদী বাজার) সামনে রেখে প্রণীত কৌশলী ভাষ্য ।
আধুনিক ইতিহাসবিদেরা ইতিহাসের বই-পত্রগুলো পাঠ করেন কঠোরতার সাথে। এর মানে হলো, আমরা এসব বই-পত্রকে সেগুলোর বৃহত্তর সামাজিক ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করি, গুরুত্ব বিচার করি, প্রমাণ মূল্যায়ন করি, একটি পাণ্ডুলিপিকে অন্যটির সাথে তুলনা করি। ইতিহাসবিদেরা পেইন্টিংস, ভবনরাজি, মুদ্রার মতো প্রমাণগুলোও বিবেচনা করেন। চূড়ান্তভাবে, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান বা ঘটনার ব্যাখ্যা করার জন্য ইতিহাসবিদেরা একটি নিয়মসম্মতভাবে ধারাবাহিক ভাষ্য নির্মাণের জন্য প্রাথমিক নথিপত্রগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন। ইতিহাস নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করার ব্যাপক অবকাশ আছে, তবে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রায়ই হয় গঠনমূলক। কিন্তু আওরঙ্গজেবের ঐতিহাসিক নথিপত্রগুলো সংগ্রহ, আত্মস্ত করা ও বোধগম্য করার প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়।
জীবনীমূলক প্রবন্ধ
আওরঙ্গজেবের এই জীবনীগ্রন্থের ভিত্তি হলো প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক উভয় সময়ের পূর্ববর্তী বিশেষজ্ঞদের রচনাবলী। এরপর আমার বিবেচনায় আনা গ্রন্থগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। আমি একই সাথে আওরঙ্গজেব অধ্যয়নের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রগুলোর কয়েকটি সম্পর্কে সারসংক্ষেপও দিয়েছি। আমি পাণ্ডুলিপির আর্কাইভগুলো খুব কমই ব্যবহার করেছি, আমার প্রাথমিক নথিপত্র নিয়ে গবেষণা প্রধানত ছাপানো সংস্করণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। উদ্ধৃতি ও অন্যান্য বিশেষ তথ্যের জন্য আগ্রহী পাঠকেরা এই অংশের পর থাকা নোটের ওপর নজর বুলাতে পারেন।
—
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ফারসি ইতিহাসগুলো– আওরঙ্গজেব আলমগিরবিষয়ক আমাদের বিপুল ঐতিহাসিক সম্পদরাশির মূল কাঠামো গঠন করেছে। আওরঙ্গজেবের প্রাথমিক জীবনের প্রধান প্রধান ঘটনা শাহ জাহান আমলের ইতিহাসগুলোতে নথিবদ্ধ হয়ে আছে। এসবের মধ্যে আমি এই গ্রন্থে আব্দুল হামিদ লাহোরির পাদশাহনামা, ইনায়েত খানের শাহজাহাননামা, মোহাম্মদ সালিহ খামবুর আমল-ই-সালিহ, তাবাতাবাইয়ের শাহজাহাননামা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছি।
আওরঙ্গজেবের আমলে অনেক লোক ইতিহাস রচনা করেছেন। মোহাম্মদ কাজিমের আলমগিরনামা, সম্পাদনা খাদিম হোসাইন ও আবদুল হাই (কলকাতা, ১৮৬৮), আওরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রথম ১০ বছরের তথ্য দেয়। এটিই ওই সময়ের একমাত্র সরকারি রাজকীয় ইতিহাস। বখতওয়ার খানের (মৃত্যু ১৬৮৫) মিরাত আল-আলম একটি সার্বজনীন ইতিহাস, যা আওরঙ্গজেব আমলের প্রথম দশকের ঘটনাবলীতে সমৃদ্ধ। সাজিদা আলভি তার পার্সপেকটিভস অন মোগল ইন্ডিয়া গ্রন্থে (করাচি, ২০১২) উল্লেখ করেছেন, বখতওয়ার খানের বইটি এখন খুবই কম পাঠ করা হয়, কিন্তু এ বইয়ে আলমগিরনামায় না পাওয়া অনেক তথ্যের সন্ধান মেলে। আকিল রাজি খানের (মৃত্যু ১৬৯৬/৭) ওয়াকিয়াত-ই আলমগিরি হলো উত্তরাধিকার যুদ্ধের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভাষ্য। আমি মৌলভি জাফর হাসানের সংস্করণটি (দিল্লি, ১৯৪৬ ) ব্যবহার করেছি। এছাড়া হাতিম খানের আলমগিরনামা, মোহাম্মদ মাসুমের তারিখ-ই শাহ শুজাই, আবুল ফজল মামুরির তারিখ-ই আওরঙ্গজেবের মতো অপ্রকাশিত ফারসি ইতিহাস গ্রন্থ রয়েছে। আমি এ বইটি লেখার কাজে এসব গ্রন্থের সহায়তা নিতে পারিনি ।