ভারতের তীব্র সমালোচিত শাসকদের মধ্যেও আওরঙ্গজেবের বিশেষ, অনাকাঙ্ক্ষিত স্থান রয়েছে। এমনকি যারা বিজেপি ও সমমনা হিন্দু জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলোর ভাবাবেগের সাথে একমত নয়, এমন সাধারণ অভিমতেও নির্মম ইসলামি উৎপীড়ক (যাদের কাছে ভারতের সবকিছু, বিশেষ করে হিন্দু মাত্রই ঘৃণিত) হিসেবে আওরঙ্গজেবকে বিদ্রূপ করা হয়ে থাকে। সীমান্তের ওপাড়ে পাকিস্তানেও অনেকে বদ আওরঙ্গজেবের ভাষ্যটি অনুমোদন করে, এমনকি তাকে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ী মনে করা হয়। পাকিস্তানি নাট্যকার শহিদ নাদিমের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন : ‘আওরঙ্গজেব যখন [তার ভাই] দারাশিকোর ওপর বিজয়ী হলেন, তখনই [ভারতবর্ষ) বিভক্তির বীজ রোপিত হয়েছিল।’ অনেক লোক অনুমোদন না করলে এ ধরনের কষ্টকল্পিত অভিমত ফালতু হিসেবে পরিগণিত হতো।
এই পাকিস্তানি নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গির নজির পাওয়া যায় আধুনিক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা জওহের লাল নেহরুর রচনাবলীতে। জওহের লাল নেহরু কোনোভাবেই আওরঙ্গজেবের অনুরাগী ছিলেন না। ১৯৪৬ সালে প্রথম প্রকাশিত ডিসকোভারি অব ইন্ডিয়ায় নেহরু বিস্তারিতভাবে আওরঙ্গজেবের অন্তর্নিহিত খুঁতগুলো তুলে ধরেন, ‘গোঁড়া ও কঠোর বিশুদ্ধবাদী’ হিসেবে তার নিন্দা করেন । তিনি ঘড়ির কাঁটা উল্টা দিকে চালানো ও মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসকারী বিপজ্জনক পূর্বানুবৃত্তিকারী হিসেবে ষষ্ট মোগল সম্রাটের সমালোচনা করেছেন । সম্ভবত নেহরুর সবচেয়ে কঠিন আঘাত ছিল আওরঙ্গজেবের মুসলিম পরিচিতির ওপর। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে আওরঙ্গজেব বাড়াবাড়ি রকমের মুসলিম হওয়ায় সফল ভারতীয় রাজা হতে পারেননিঃ ‘আওরঙ্গজেব যখন [আগেকার মোগল শাসকদের সমন্বয়বাদের] বিরোধিতা ও একে দমন করা শুরু করেন এবং ভারতীয় শাসক হিসেবে নয়, বরং মুসলিম হিসেবেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন, তখন মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। নেহরুর মতে, ইসলামের প্রতি আওরঙ্গজেবের দৃঢ়ভাবে অনুরক্ত থাকাটাই তার ভারতবর্ষ শাসন করার সক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছিল।
আওরঙ্গজেব বিপজ্জনকভাবে ধার্মিক ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি খারাপ সম্রাট ছিলেন- এমন ধারণা কেবল নেহরুই পোষণ করতেন, তা নয়। নেহরুর সমসাময়িক আরো অনেকেই এ ধরনের মতবাদ সমর্থন করেছেন। এদের অন্যতম ছিলেন বিশ শতকে আওরঙ্গজেবের ইতিহাস রচনাকারী যদুনাথ সরকার। ব্রিটিশ উপনিবেশিক চিন্তাবিদেরা আরো অনেক আগে থেকেই মোগলদেরকে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছিলেন। তাদের অভিযোগের মধ্যে ছিল মোগলরা কামুক, উৎপীড়ক ও মুসলিম। আলেকজান্ডার ডো ১৭৭২ সালেই মোগল শাসন সম্পর্কে এক আলোচনায় মন্তব্য করেছিলেন যে ‘মোহাম্মদের ধর্ম অদ্ভূতভাবে স্বৈরতন্ত্রের সাথে খাপ খেয়ে যায়, এবং প্রাচ্যের এ ধরনের সরকারের টিকে থাকার কারণগুলোর সাথেই তা সম্পর্কিত।’ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের জন্য ব্রিটিশদের কাছে সমস্যাটির এই সমাধান যে প্রয়োজনীয় ছিল, তা স্পষ্ট। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা উপনিবেশিক যুক্তির শেষ ধাপটি প্রত্যাখ্যান করলেও অনেকেই কোনো বাছবিচার না করেই প্রথম অংশটি গ্রহণ করে নেন। পাঠ্যবই ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে এসব ধারণা সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, কয়েকটি প্রজন্ম ধরে আওরঙ্গজেব ধর্মীয় উগ্রবাদে তাড়িত উৎপীড়ক শাসক ছিলেন, এমন উপনিবেশিক ধারণা গলধঃকরণ করে তা বমনও করছে।
—
কয়েক শ’ বছর ধরে একেবারে হালকা প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে অনেক ভাষ্যকার দুষ্ট, গোঁড়া আওরঙ্গজেবের কল্পকথা প্রচার করেছেন। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা এখনো লোকরঞ্জক স্মৃতিতে বিরাজ করছে। এসব ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে রয়েছে তিনি লাখ লাখ হিন্দুকে হত্যা করেছেন, হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করেছেন। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা এসব ‘তথ্য’ ঐতিহাসিক প্রমাণে না টিকলেও কোনো কোনো পণ্ডিত, সাধারণত খারাপ উদ্দেশ্যে, এ ধরনের আষাঢ়ে গল্পের একটি কথিত ভিত্তি প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য, আরো বেশি দেখা যায় আওরঙ্গজেবকে নিয়ে আগে উল্লেখ করা সমালোচনাগুলো টিকিয়ে রাখার নির্লজ্জ লক্ষ্য হাসিলের জন্য সুবিধাজনক কিছু নির্বাচিত ঘটনার পক্ষপাতপূর্ণ ব্যবহার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সমালোচকেরা সুর তোলেন যে আওরঙ্গজেব অমুক অমুক মন্দির ভেঙ্গেছেন। কিন্তু তারা এ কথা স্বীকার করেন না যে তিনি অনেক হিন্দু মন্দির রক্ষা করার জন্য অসংখ্য আদেশ জারি করেছেন, ব্রাহ্মণদের বৃত্তি ও ভূমি মঞ্জুর করেছেন। তারা হলি উদযাপনে তার কড়াকড়ি আরোপের নিন্দা করেন একথা উল্লেখ ছাড়াই যে তিনি মোহাররম ও ঈদের অনুষ্ঠানও কাট-ছাঁট করেছেন। তারা বেমালুম চেপে যান যে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের সাথে পরামর্শ করতেন, আগের যেকোনো মোগল শাসকের চেয়ে তিনি অনেক বেশি সংখ্যক হিন্দুকে তার প্রশাসনে নিয়োগ করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের শাসন-সংশ্লিষ্ট অনেক কম উল্লেখ করা তবে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর সাথে এই শাসককে নিয়ে ধর্মভিত্তিক ঘৃণায় চালিত কাল্পনিক চরিত্রকে সমন্বিত করার কাজটি আমরা করতে পারি না।