—
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনার জন্য আওরঙ্গজেবকে সম্ভাব্য দায়ী করার বিষয়টি সরিয়ে রেখে আমরা কিভাবে এই জটিল, অনেক সময় সাংঘর্ষিক চরিত্রের সম্রাটের দীর্ঘ, অসম শাসনকালকে মূল্যায়ন করতে পারি? আধুনিক মানদণ্ডের আলোকে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা নিয়ে আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করার মধ্যে অন্তঃদৃষ্টির অবকাশ থাকে সামান্যই । কিন্তু তার সময়ের অন্যান্য শাসকের সাথে, বিশেষ করে পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটদের সাথে তিনি কিভাবে তুলনীয় তা আরো ফলপ্রসূভাবে জানতে চাইতে পারি ।
আওরঙ্গজেব তার পূর্ববর্তী যেকোনো মোগল সম্রাটের চেয়ে, অন্তত অনেক মোগল প্রথার প্রতিষ্ঠাতা আকবরের পর থেকে, অনেক বেশি মোগল রীতিনীতি ভেঙেছেন। কিন্তু কিছু শিল্পকলার ওপর থেকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস করা, দাক্ষিণাত্যে সরে যাওয়া, জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তনের মতো অনেক পরিবর্তন সাধন সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব মোগল প্রশাসনিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির দিক থেকে বিপুলভাবে ধারাবাহিকতাই রক্ষা করে গেছেন। তিনি আকবরের মতো আন্তঃসংস্কৃতির পথিকৃত ছিলেন না (হয়তো ভারত সম্রাজ্যের ষষ্ট শাসক হিসেবে তিনি এর প্রয়োজন আছে বলেই মনে করতেন না)। কিন্তু আওরঙ্গজেব ফতোয়া-ই-আলমগিরির মতো বিশাল মাত্রার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, কয়েকটি ফারসি রামায়ণ তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। শাহ জাহানের সমমানের মহান নির্মাতা ছিলেন না আওরঙ্গজেব, কিন্তু তবুও যদি লাহোরের বাদশাহি মসজিদ বিবেচনা করা হয়, তবে তিনি খুব পিছিয়েও থাকবেন না। বর্তমানে বেশির ভাগ লোক যেমনটা মনে করে, তার চেয়েও মোগল পূর্বসূরীদের সাথে অনেক বেশি সমরূপ ছিলেন তিনি।
আওরঙ্গজেব তারপরও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন, বিশেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি তার গতানুগতিক উদ্বেগ ও তার সামরিক নৈপূণ্যের দিক থেকে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পূর্ববর্তী মোগল শাসকেরাও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরের কথা বলা যেতে পারে । যে কেউ যাতে সম্রাটের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, সেজন্য জাহাঙ্গীর আগ্রা দুর্গ থেকে নদীর কিনারা পর্যন্ত ৬০টি ঘণ্টা-সংবলিত একটি বিশাল ‘ন্যায়বিচারের শিকল’ ঝোলানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে ন্যায়বিচার ছিল অনেক কম প্রদর্শনীর বিষয়। তিনি অসৎ প্রশাসকদের দমন করা ও নিরাপদে ধর্মীয় উৎসবের নিশ্চয়তা দানকেই বুঝতেন ন্যায়বিচার। অবশ্য সম্রাটের ইচ্ছা সত্ত্বেও আওরঙ্গজেবের প্রশাসন দুর্নীতির মতো জঘন্য কাজ করত। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেব তার সারা জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও মধ্য যুগের অন্য অনেক রাজার মতো তিনিও বারবার চির অতৃপ্ত রাজনৈতিক শক্তির জন্য তার ঘোষিত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।
আওরঙ্গজেব ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দারুণ দক্ষ সামরিক কৌশলবিদ । তিনিই সম্ভবত ছিলেন মোগল ধারায় সবচেয়ে সুদক্ষ জেনারেল। তিনি দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার লড়াইয়ের মাধ্যমে ময়ূর সিংহাসন জয় করেছিলেন। কয়েক প্ৰজন্ম ধরে মোগলদের কাম্য দাক্ষিণাত্য তিনি জয় করেছিলেন। কিন্তু তারপরও প্রবীণ আওরঙ্গজেব যেকোনোভাবেই হোক না কেন, দক্ষিণ ভারতে তার পথ হারিয়েছিলেন, লক্ষ্যহীনভাবে দুর্গগুলো দখল করছিলেন, বৃদ্ধ বাদশাহ ও দুর্বল যুবরাজদের কাছ থেকে সুযোগ গ্রহণে ইচ্ছুক প্রশাসকদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হারে নির্বিষ হয়ে ওঠেছিলেন।
আওরঙ্গজেবের শাসনকাল যদি ২০ বছর সংক্ষিপ্ত হতো, জাহাঙ্গীর (তিনি শাসন করেছিলেন ২২ বছর) বা শাহ জাহানের (তিনি শাসন করেছিলেন ৩০ বছর) কাছাকাছি সময় পর্যন্ত শাসন করতেন, তবে আধুনিক ইতিহাসবিদেরা হয়তো তাকে ভিন্নভাবে বিচার করতেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের শেষ দশকগুলোতে ছেলেদের শৃঙ্খলিত করা, ক্রমবর্ধমান হারে স্ফীত হয়ে ওঠা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল থাকা, বাজে পরামর্শপুষ্ট যুদ্ধে নিয়োজিত হওয়া ছিল তার জট পাকানো উত্তরাধিকারের বিশাল অংশ। ফলে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া হয়েছে বিপুল উচ্চাভিলাষ ও মোগল ভারতের বাস্তবতার মধ্যে অপূরণীয় ব্যবধানে জর্জরিত একজন জটিল মানুষ ও রাজার মিশ্রণ মূল্যায়ন ।
আওরঙ্গজেবকে শৃঙ্খলমুক্ত করা
সময়, পরিস্থিতি, ইতিহাস আমাকে যা বানিয়েছে, আমি অবশ্যই তাই, তবে তারপর আমি তার চেয়েও বেশি কিছু। আমরা সবাইই তাই ।
–জেমস ব্যান্ডউইন, আমেরিকান লেখক, ১৯৫৫
আওরঙ্গজেবের লোকরঞ্জক স্মৃতির সাথে ঐতিহাসিক সম্রাটের রয়েছে স্রেফ ঝাপসা সাদৃশ্য। এই অমিল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণ হলো উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক ধারণার প্রশমন করা এবং অপরটি হলো ঐতিহাসিক গবেষণাকে শৃঙ্খলমুক্ত করা ।
আওরঙ্গজেবের লোকরঞ্জক খ্যাতির ফলে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই মোগল অতীত নিয়ে রাজনৈতিক ইন্ধনযুক্ত ভাষ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, আওরঙ্গজেবের দুই ভাষ্যই (ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেব ও ধার্মিক আওরঙ্গজেব) প্রকাশ্য ধারায় পরিণত হয়েছে। ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেবের চিত্রটি বিশেষভাবে বিভ্রান্তিকর ও ধ্বংসকারী। এতে হিন্দু ও হিন্দুবাদকে ধ্বংস করতে আগ্রহী উগ্র আওরঙ্গজেবের চিত্র আঁকা হয়। মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগ বাড়াতে ও ভারতীয় মুসলিমদেরকে বিপজ্জনক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করতে ভারতের রাজনীতিবিদ ও অন্যরা এই ধারণা প্রচার করে। আওরঙ্গজেবকে বিশুদ্ধ মুসলিম (উর্দু কবি মোহাম্মদ ইকবাল, মৃত্যু ১৯৩৮, তাকে ‘ভারতের মূর্তি গৃহে ইব্রাহিম’ হিসেবে অবহিত করেছিলেন) হিসেবে চিত্রিত করাও সমস্যাসঙ্কুল। এভাবে উপস্থাপনের ফলে এই ধারণা সৃষ্টি করে যে মুসলিমরা প্রধানত তাদের বিশ্বাসের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হয়, আর ইসলাম হলো মৌলিকভাবে হিন্দু ধর্মের চেয়ে আলাদা। ভারতবর্ষের জন্য এই ধারণার অর্থ হলো এই যে মুসলিমেরা পুরোপুরি ভারতীয় হতে পারে না, আর পাকিস্তানে তারা ধারণা দেয় যে সব মূল্যবান নাগরিককে অবশ্যই ইসলামের সংকীর্ণ ধরনের সংজ্ঞায় থাকতে হবে।